![]() |
| এই ছবিটি প্রতীকি । গল্পের চরিত্রের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই । এটি ইন্টারনেট থেকে নেয়া। |
শীতকাল চলে আসছে ফের । এই কাল আমার প্রিয় কাল ছিল । বিশেষ করে ঘুম এবং খাওয়া এবং ক্রিকেট খেলার জন্য শীত সবচেয়ে প্রিয়। তবে যাদের শীতের পোশাক নেই তাদের কথা ভাবলে কষ্ট লাগে । যাদের শীত এলেই দিন মজুরের সুযোগ কমে যায় তাদের কাছে শীত মূলত জমদূত । কি বৈপরীত্যে পূর্ণ নিয়ম দুনিয়াটার ! যে শীতে আমাদের আনন্দে কাঁপায়, সেই শীতে হাড় কাঁপে মানুষের বেদনায় । শীতকালকে আমি প্রিয়কালের তালিকা থেকে বাদ দিয়েছি একটি বিশেষ ঘটনার কারণে । সেটি বলছি।
আমাদের পৃথিবীটা অনেক বেশি সুবিধাপ্রাপ্তদের দখলে । গরীব ও খেটে খাওয়া মানুষের যে সম্পদশালীদের সম্পদে অংশীদারিত্ত্ব রয়েছে এই সত্যটি আমরা ভুলে গিয়েছি । তার ফলে আমরা বাহারী শীতের পোশাক আর কম্বল গায়ে তৃপ্তি করবো , আর অন্যদিকে আগুন জ্বেলে দেহের তাপমাত্রা বৃদ্ধি করার আদিম পদ্ধতি অবলম্বণ করবে বেশিরভাগ মানুুষ ।
আমি যখন স্কুলে পড়তাম সেসময়ের ঘটনা। তখন সকাল সাড়ে সাতটায় একটা ব্যাচে পড়তাম । শীতের সকাল। আমার সাথে পড়তো ক । শীতের ভোরে আমরা সবাই স্কুল ড্রেসের উপর বা নিচে মোটা কাপড় পরে আসতাম । আমি গায়ে দিতাম জিন্সের একটা জ্যাকেট । তো আমি লক্ষ্য করলাম যে , আমার ক্লাসমেট “ক” এই শীতেও স্কুল ড্রেসই পরে আসে । সাদা পাতলা একটি শার্ট আর নেভি ব্লু প্যান্ট । আমি একদিন দেখলাম, দুদিন দেখলাম, তিনদিন দেখলাম এবং পুরো দশ দিনের মত দেখলাম । শৈত্য প্রবাহেও সে স্কুলের ড্রেসেই আসে । কারো ব্যক্তিগত ব্যাপার, পরিবার এসব নিয়ে আমার কোন আগ্রহ কোনকালে থাকেনা । এটি আমার পারিবারিক শিক্ষা । কোন মানুষকে জাজমেন্ট করার জন্য শুধু তাকেই মানদনড করবে । কিন্তু ক এর ক্ষেত্রে আমি সে নিয়ম ভাঙলাম। আমি ওর ব্যাপারে এর ওর কাছে শুনলাম । যা জানলাম তা জেনে আমি সেই ক্লাস সেভেনে থাকতে এক রাত প্রায় ঘমাতে পারিনি । চোখ জুড়ে পানি চলে আসছিল অজান্তে ।
জানলাম ক এর কথা । সে খুবই পরিশ্রমী ছেলে । ধবধবে গায়ের রঙ। এলাকায় যারা ধান চাষ করে ওদের জমিতে কাজও করে । যখন স্কুল বন্ধ হয় তখন সে ভ্যান চালিয়ে প্রাইভেট পড়ার ও বেতন দেয়ার টাকার পাশাপাশি বই কেনার টাকা উপার্জন করতো । ছেলেটির বাবা ছিলনা । আমি তারপরে ওর সাথে ঘনিষ্ট হওয়ার চেষ্টা করলাম।
আমার বেস্ট ফ্রেন্ড করার যত চেষ্টা করতাম ও আড়ষ্ঠ ছিল। সেটি যে কি কারণে সেটা আমি বুঝতাম । আমি চেষ্টা করে ওর সাথে মিশি। একদিন ওকে বললাম, ক , শীতে তুমি যদি জিন্সের জ্যাকেট পরো তবে নায়কের মত লাগবে । ওকে আমার জ্যাকেট পরিয়ে দিলাম । চিল্লাচিল্লী করে বললাম, দারুন লাগছে! কিন্তু সত্যি বলতে, ওর ওটা পছন্দ হয়নি । ও বললো, বন্ধু এইটায় ভাব হয় । শীত তো মানায়না । আমি বুঝলাম, ও যে এতদিন ওর গরম লাগে, শীত লাগেনা বলেছে তা আসলে ওর অবস্থাকে স্বাভাবিক রূপ দেয়ার মহান চিন্তার উপস্থাপন ছিল । আমরা সেদিন গল্প করলাম। টিফিন করলাম । খেললাম । এবং ওকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে এলাম। এবং তার পরদিন আমি ওর জন্য আমার উলের সোয়েটারটা নিয়ে এলাম ব্যাগে । কিন্তুু দিতে সাহস পাচ্ছিলাম না । আমি ঐ দিন “ক” কে বললাম , চল, আজ তোমাদের বাড়ি যাবো । ও প্রথমে ইতস্তত করলেও আমি জোরাজুরি করায় যেতে রাজি হলো । ওর বাসায় গিয়ে মুড়ি আর চানাচুর খেতে খেতে আমি বললাম, বন্ধু , তুমি আজ আমাকে একটা জিনিস দিবা আর আমিও তোমাকে একটা জিনিস দিবো । কি? রাজি? ও হ্যাঁ বলে, দুশ্চিন্তায় পড়ে বলে, কি দেবো তোমারে? আমি বললাম, তোমাকে একটা কিছু দেয়ার অনুমতি । সে বলে দাও । আমি ব্যাগটা খুলে ওর হাতে দিলাম । সোয়েটার । ওর চোখে পানি । আমি বললাম, আমরা তো দুই ভাইয়ের মত । না?
ও আমাকে কাঁদতে কাঁদতে জড়িয়ে ধরে বললো,এইটা আমার মা’কে দিলে তুমি রাগ করবা? উনি বুড়ো মানুষ । শীতে চাদর গায়ে দিয়েও কাঁপে । আমি বললাম, তুমি যা ইচ্ছে করো এটা । এটা তো তোমার । জিন্সের জ্যাকেটটা খুলে বললাম, এটাও রাখো ভাই । ও বললো, না এটা লাগবেনা । আমার কোনমতে চলে গেলে হলো । জীবনের এমন কঠিন রূপ আমি এর আগে কোনদিন দেখিনি ।
আমি মন খারাপ করে বাড়ি চলে আসলাম । সেদিন ভেবেছিলাম, আমার অনেক টাকা থাকলে আমি ক এবং ক’দের সব মা’কে শীতের কাপড় কিনে দিতে পারতাম । তারপর থেকে শীতকাল আমার প্রিয়কালের তালিকায় নেই । কোনকালে কোন পরীক্ষায় আমি “ তোমার প্রিয় ঋতু ” রচনায় “শীতকাল” লেখিনি । আমি জানি এই শীতকাল সত্যি সত্যিই কাল বহু মানুষের জীবনে । কালসাপ যেন। আমি তাদের ভাবি । তারা আমাকে ভাবায় । আমি চলে যাই সেদিনের ঘটনায় ।
