সর্বশেষ

ফেসুবক ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাংবাদিকতা : চ্যালেঞ্জের মুখে মূলধারা

মঈনুল রাকীব
...............................................................................................................................................................

কোটা সংস্কার আন্দোলনের এক মহাবীর। এমন একটা ছবি সহস্র টেলিভিশন চ্যানেলের চেয়েও শক্তিশালী। আপনার স্মার্টফোনটিকে কেবল আন্তরিকতার সাথে ব্যবহার করতে হবে। তারপর ছড়িয়ে দিতে হবে ফেসবুকে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এসে প্রচলিত সংবাদমাধ্যমকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। সোর্স তৈরি করা থেকে শুরু করে সোর্সের সাথে যোগাযোগ, প্রাসঙ্গিক তথ্য-উপাত্ত, ছবি এবং ভিডিওচিত্র পর্যন্ত পাওয়া যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে। এ কারণে মূলধারার সংবাদমাধ্যম অর্থাৎ টেলিভিশন ও পত্রিকার এজেণ্ডা সেট করার সুযোগ অনেক কমে গেছে। কারণ পাঠক ফেসবুক ব্যবহার করে। ফেসবুকেও রয়েছে সার্চ ইঞ্জিন। এর ফলে চলমান যে কোন ঘটনার কিওয়ার্ড লিখে সার্চ দিলে সে বিষয়ে দেশের মানুষ, বিদেশের মানুষ যা ভাবছে তা চলে আসবে টাইমলাইনে। ফলে মিথ্যা তথ্য দিয়ে পাঠককে বিভ্রান্ত করা কিংবা একটি নির্দিষ্ট পয়েন্ট অভ ভিউতে নিউজ করে প্রোপাগাণ্ডা চালানোটা কঠিন হয়ে পড়েছে।
আপনার ফেসবুক একাউন্ট এবং আপনার স্মার্টফোনের শক্তি সম্পর্কে আপনি অবগত কি? বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শক্তি কি জানেন? ‘ক্যামেরা ও অডিও’। এই ক্যামেরা ও অডিও তে ধারণ হতে কেউ চায়না। এটি প্রমাণ। আপনি ফেসবুক ব্যবহার করে যেকোন অসত্যকে এখন চ্যালেঞ্জ করতে পারেন। আবার যেকোন ঘটনা যদি মূলধারার তথাকথিত গণমাধ্যমে কাজ করা ব্যবসায়ীদের চাকর-চাকরানীরা প্রকাশ করতে না চায় বা না করে তবে আপনি আপনার এন্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেমের ফোনটিকে ইন্টারনেটের সাথে সংযুক্ত করেই নিজের মিডিয়া চালু করতে পারেন। আপনার রয়েছে ফেসবুক লাইভ, আপনার রয়েছে ইউটিউব, আপনার রয়েছে নিজেরই প্রচার করার পূর্ণ সক্ষমতা। আপনার কর্পোরেটদের কাছে জিম্মি থাকার দিন শেষ। আস্ত একটা ভোগবাদী আরব বিশ্বকে নাড়িয়ে দেওয়া আরব বসন্ত হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে। অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট, হামবুর্গের পুঁজিবাদবিরোধী বিশাল সমাবেশ হয়েছে সামাজিক মাধ্যমে সংগঠিত হয়ে। মূলধারার মিডিয়া বলে পরিচিত টেলিভিশন, অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও পত্রিকাই এখন ফেসবুকে বা ইউটিউবে একাউন্ট খুলে অডিয়েন্সের কাছে আসতে চেষ্টা করছে। সুতরাং বাংলাদেশে যারা কোটা সংস্কার আন্দোলন করছেন দয়া করে কেউ ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদদের বুদ্ধিবৃত্তিক দাসদের ভয় পাবেননা। মুন্নী, প্রভাষ আমিনরা আপনাদের সংবাদ না করলে বেতনভাতা পাবেনা। আপনারাই এবার এজেন্ডা সেট করবেন। আপনারা ফেসবুকের নিজেদের প্রচারণা চালান। টার্গেট যেহেতু মানুষ, সেহেতু ফেসবুকেও আপনি পাবেন মানুষ এবং যত মানুষ টিভি দেখে তার চেয়ে শত গুণ বেশি মানুষ। ভয় কিসের?

কোটা সংস্কারের যৌক্তিক লড়াই চালিয়ে যান। আর প্রচারণা চালান নিজের ফেসবুকে। পোস্ট পাবলিক করে দিন। বিভিন্নগ্রুপে দিন। নাগরিক সাংবাদিক হয়ে যান। যার হাতে একটি ফোন আছে, যার ফোনে ইন্টারনেট আছে এবং যার রয়েছে ফেসবুক এপস, সেই সবচেয়ে সক্রিয় নাগরিক সাংবাদিক বা সিটিজেন জার্নালিস্ট। আমি সাংবাদিকতা বিভাগে যে পড়েছি সেখানে যে সিটিজেন জার্নালিজম পড়ানো হয়েছে তা চিঠিপত্র বিষয়ক। কিন্তু আমি বুঝি, এখন চিঠিপত্র লেখার যুগ নয়। এখন স্ট্যাটাস লেখার যুগ, ভিডিও পোস্ট করার যুগ, এখন ছবি ভাইরাল হওয়ার যুগ। এবং এখনই আসলে সত্যিকার সিটিজেন জার্নালিজমের সময়। আপনিও হয়ে যান সিটিজেন জার্নালিস্ট। কে আপনার খবর করবে না করবে সেটা তার ব্যাপার। আপনি কেন আপনার খবর প্রচার থেকে বিরত থাকবেন? আপনার খবর দিয়ে, আপনার আন্দোলনের খবর কাভার করে যাদের রুটি-রোজগারের ব্যবস্থা হয় সেই অকৃতজ্ঞরা যদি আপনার খবরকে বয়কট করে আপনিও তাদের বয়কট করুন। মনে রাখবেন, আপনি সংবাদের সোর্স, আপনিই শেকড়। ওরা আপনি ছাড়া শূন্য। সেই বিষয়টি আপনি অনুধাবন করুন। কেবল মিথ্যা ও গুজব রটানোর থেকে বিরত থাকুন। কারণ মুক্তি রয়েছে সত্যে, মিথ্যায় কেবল সংকট বৃদ্ধিই পাবে। আপনি সত্য প্রকাশ করে কিভাবে সাংবাদিকতা কর তে পারেন সে বিষয়ে একটু আলোচনা করি চলুন।
শোনেন ভাই, আমি সাংবাদিকতা বিভাগে পড়েছি। আমার একটু আধটু এই সামাজিক মাধ্যম নিয়ে গবেষণা আছে। এর ক্ষমতা অসীম। সুতরাং মূলধারার ব্যবসায়ীদের কবলে থাকা মিডিয়া নিয়ে ভাববেননা। আপনার হাতে একটি স্মার্টফোন আছে, তাতে ইন্টারনেট আছে এবং আপনি ফেসবুক বা টুইটার বা ইউটিউবে রয়েছেন মানেই আপনি সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত। এটাকে বলে নাগরিক সাংবাদিকতা। সিটিজেন জার্নালিজম। আপনার ফেসবুক আইডি আপনার মিডিয়া এবং এর প্রভাব টেলিভিশন ও পত্রিকার চেয়ে এক ইঞ্চিও কম নয় যদি একে ব্যবহার করতে পারেন। তবে সত্য মুক্তি দেয়। কিছুতেই মিথ্যা বা গুজব ছড়াবেননা। এখানে কিভাবে ফেসবুক ও অন্যান্য সামাজিক মাধ্যম মূলধারার মিডিয়ার সংবাদের উপর একচেটিয়া খবরদারিকে চ্যালেঞ্জ করেছে সে বিষয়ে মোটামুঠি একটা ধারণা দেয়া হয়েছে। সময় পেলে পড়তে পারেন কিভাবে আপনার ফেসবুক বা স্মার্টফোন একটি মিডিয়াতে পরিণত হবে সেই বিষয়ে...।

কিভাবে প্রচার করবেন ভাবছেন? একদম সহজ। নিচের কিছু পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারেন।
১। আপনি ফেসবুক লাইভে থাকতে পারে। এতে করে মেমরি লাগবেনা আবার সবাই ভিডিও দেখতে পারবে তাৎক্ষণিক। সত্যি বলতে ফেসবুক লাইভ টেলিভিশনের লাইভের চেয়ে কোন অংশে কম শক্তিশালী না। এ কারণেই প্রত্যেক টেলিভিশন চ্যানেল তাদের ফেসবুক পাতায় লাইভ টেলিকাস্ট করে আপনারা দেখবেন
২। যদি চার্জ না থাকার ভয় থাকে তবে প্রতি মুহূর্তের ছবি তুলুন এবং তা পোস্ট করুন চমৎকার কিছু হ্যাশট্যাগ দিয়ে এবং পোস্ট পাবলিক কি না সেটি লক্ষ রাখবেন। পোস্টগুলো আপনার পরিচিত গ্রুপগুলোতেও দিন টাইমলাইনের পাশাপাশি
৩। যদি আপনার স্মার্টফোন না থাকে, তবে অন্তত অন্যদের ভিডিওতে কিছু কথা বলুন
৪। সাংবাদিকরা আন্দোলনকারীদের মন্তব্য নিয়ে সংবাদ করে। সেই সংবাদ আপনিও তৈরি করতে পারেন। যত বেশি পারবেন আপনার আশেপাশের কারো কাছে গিয়ে জানতে চাইবেন তারা কেন আসছে, কি দাবিতে আসছে  এবং এটাই আপনার মূল্যবান ভক্স পপ। আপনি জানেনও না যে এই ন্যাচারাল ভক্স পপের নিউজ ভ্যালু কতটা বেশি ঐ সাজানো কাটছাট করা টিভির ভক্স পপের চেয়ে
৫। ব্যাকআপ চার্জার বা পাওয়ার ব্যাংক রাখুন সঙ্গে যাতে কোন ঘটনা মিস না হয়
৬। যখন কোন সংঘর্ষ ভিডিও করবেন তখন প্রথমে একটু বর্ণনা দিয়ে চুপ করে ক্যামেরা তাক করে বসে থাকুন বা প্রয়োজনে নিরাপদে দৌড়ে যান এবং অবশ্যই ক্যামেরা অন রেখে। আপনার ক্যামেরার এই ঝাঁকুনীই আপনার সঠিকতা, বিশ্বাসযোগ্যতা , অথেনটিসিটি যা ঐ মূলধারার ভিতুদের সকলের নেই। সুতরাং এগিয়ে যান
৭। কেন কোটা সংস্কার এই দেশ ও জাতির জন্য প্রয়োজনীয় সেটি ব্যাখ্যা করে লিখনু, বলুন, ভিডিও করুন, অন্যের যৌক্তিক লেখাকে শেয়ার করুন

৮। মোবাইল ক্যামেরা দিয়ে ভিডিও করার সময় যত বেশি সম্ভব ক্যামেরার পিছন থেকে কথা বলা বন্ধ রাখুন। ভিডিও করার সময় হয়তো মনে হতে পারে কথা বললে ভাল হবে কিন্তু একজন ভ্লগার, ইউটিউবার ও  সাংবাদিকতার ছাত্র হিসেবে আমার অভিজ্ঞতা বলে পরবর্তী সময়ে যারা ্এই ভিডিও দেখবে তাদের জন্য পিছনের কণ্ঠটি নয়েজ তৈরি করে বা বিরক্তিকরও হতে পারে। তবে গুরুত্বপূর্ণ সময়ের আগে প্রয়োজনে কিছু বলতে পারেন
৯। কোটা সংস্কার আন্দোলনে যে প্লেক্যার্ড, ফেস্টুন, ব্যানার থাকে সেগুলোর ছবি, ভিডিও প্রকাশ করু
১০। পুলিশ বা অন্য যেকোন বাহিনীর টিয়ারশেল, বুলেট নিক্ষেপ, লাঠিচার্জের সময় নিরাপদ দূরত্বে থেকে তা প্রচার করুন, ভিডিও ও ছবি আকারে। এতে করে আপনাদের আন্দোলনের নৈতিকতাকে কেউ প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারবেনা
১১। কেউ হুমকি-ধামকি দিলে তা ভিডিও করুন। প্রয়োজনে এন্ড্রোয়েড এপস স্টোর থেকে ব্যাক ক্যামেরা বা স্পাই ক্যামেরা এপস ডাউনলোড করে রাখুন
১২। অবশ্যই সঙ্গে পাঁচ টাকার টুথপেস্ট রাখবেন টিয়ারশেল থেকে সাময়িক চিকিৎসা নিতে
১৩। নারী, প্রতিবন্ধী, উপজাতিদের মন্তব্য ও বিবৃতিকে গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করুন। তাদের সংবাদমূল্য রয়েছে
১৪। আপনি সাংবাদিকতা করার সময় নিজের নিরাপত্তার ব্যাপারে সতর্ক হবেন। সবার দিকেই ক্যামেরা তাক করে দিবেনননা। পারলে আগে অনুমতি নিয়ে নিন বা অন্তত ঈশারায় বুঝিয়ে দিন আপনি ভিডিও করছেন বা ছবি তুলছেন। সেক্ষেত্রে আপনার গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেড়ে যাবে। ইউটিউবে আপলোড করার পর ফেসবুকে প্রকাশ করতে ভুলবেননা এবং যত দ্রুপ পারেন কার্যকর গ্রুপে শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন। যেসব মিডিয়া মিথ্যা তথ্য দেয়, তাদের ফেসবুক পাতায় গিয়ে নিচে সত্য ঘটনা লিখে দিন। প্রতিবাদ করুন। মিথ্যার বালির বাঁধ ভেঙে যাবে।
১৫। মনে রাখবেন আপনি যখন কোন ঘটনা দেখেন ও তা প্রচার করেন তখনই আপনি সাংবাদিক। কোন মাধ্যমে করছেন সেটি বড় নয়, আপনি কি প্রচার করছেন সেটি অনেক বড় ব্যাপার। আপনার তথ্য সত্য হলে, যৌক্তিক হলে ঐ মূলধারার মিডিয়ায় আপনার ভিডিও বা ছবি বা পোস্ট নিয়েই নিউজ করবে বা করতে বাধ্য হবে। আপনিই সংবাদ, আপনিই সংবাদমাধ্যম। ইন্টারনেটের বিস্ময় এটিই যে আপনার স্মার্টফোন ও ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আপনার মাধ্যমে সত্য প্রকাশের সহস্র উপায় রেখেছে। আপনার সোস্যাল মিডিয়া জার্নালিজমের জন্য শুভকামনা রইলো। শ্লোগান হোক:
বঙ্গবন্ধুর বাংলায়, বৈষম্যের ঠাঁই নাই
তোমার আমার ঠিকানা, ৫৬% কোটানা
দেশের মানুষ দিচ্ছে ডাক
কোটার অভিশাপ নিপাত যাক
এক দফা এক দাবি ভাই
কোটামুক্ত বাংলাদেশ চাই

 

অন্য দিকে সংবাদ তৈরি করার ক্ষেত্রে ফেসবুক টুইটারের ভূমিকাও অপরিসীম। পশ্চিমা বিশ্বে বহু আগে থেকেই এটা শুরু হয়েছে। অর্থাৎ কোন ব্যক্তির টুইটকে সংবাদের উৎস হিসেবে ধরা। ইহুদীবাদী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তো সংবাদ সম্মেলনের চেয়ে ‍টুইটার পোস্টে বেশি সক্রিয় এবং তার প্রত্যেকটি টুইটই সংবাদমূল্য সংবলিত। এমনকি তার ফেইক নিউজ তত্ত্বও এই টুইটার ও ফেসবুকের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় হয়েছে। ফেসবুকও অনেক সময় সংবাদের উৎস হচ্ছে। যেমন সর্বশেষ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যে সাইকোপ্যাথিক কিলার একজন বৃদ্ধকে হত্যা করলো তাকে চিহ্নিত ও তার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে ওঠে ফেসবুকেই । এর পর নিউইয়র্ক টাইমস, সিএনএন, ফক্স নিউজ করে। বাংলাদেশে রাজন হত্যাকাণ্ড, তনু হত্যা, রাকিব হত্যা, খাদিজাকে কোপানো বদরুলকে উন্মোচন এসব ফেসবুকের মাধ্যমে পাওয়া তথ্য। ফেসবুক না থাকলে মেইনস্ট্রিম মিডিয়া এই সব ঘটনার কোন সংবাদই করতে পারতোনা। এটাই সোস্যাল মিডিয়ার সফলতা। সোস্যাল মিডিয়া যেখানে যেতে পারে, মূলধারার মিডিয়া তার ধারেকাছেও যেতে পারেনা। সে কারণে ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন যখন কথিত মূলধারা সংবাদমাধ্যম নেতিবাচকভাবে তুলে ধরতে চেষ্টা করে বা নিউজ কাভারেজই দেয়না, তখন এই ফেসবুকই বাংলাদেশের তরুণ সমাজের শক্তিশালী মাধ্যম রূপে উপস্থিত হয়।

একটা সময় মূলধারার সাংবাদিকতায় সম্পৃক্ত সংবাদকর্মীদের কোন জবাবদিহি করা লাগতোনা পাঠকের কাছে। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের তুমুল জনপ্রিয়তার কারণে সেই প্রবণতা বিলুপ্ত হয়েছে। এখন মূলধারার সংবাদমাধ্যমকে তুলোধুনা করা হয় সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে। সোস্যাল মিডিয়ার কাছে মেইনস্ট্রিম এতটাই দুর্বল যে, মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার মিথ্যাচারের সমালোচনা করলেও ‘সোস্যাল মিডিয়ায় ঝড়’ শীর্ষক শিরোনাম দিয়ে তা কাভার করতে হয়। (এই প্রথম ইভটিজিং নিয়ে তৈরি ছোটদের সাড়া জাগানো শর্ট ফিল্ম দেখতে এখানে ক্লিক করুন) আর যেকোন সংবাদমাধ্যমে আসা সংবাদ সোস্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীদের তীক্ষ্ণ সমালোচনার তীরে বিদ্ধ হতে হয়। সম্প্রতি বসুন্ধরা গ্রুপের মিথ্যা সাংবাদিকতায় ক্ষুব্ধ ফেসবুক ব্যবহারকারীরা খোদ বসুন্ধরার সাংবাদিকতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করতে সফল হয়েছে। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্রদের বসুন্ধরার কুস্বার্থে জঙ্গী বলাকে সোস্যাল মিডিয়ায় ‘জঙ্গী সাংবাদিকতা’ নামে ট্রল করা হয়। ২০১৬/২০১৭ সালে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যাট-বিরোধী আন্দোলনটি সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি পায়।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর রান্না করার ছবি মেইনস্ট্রিম সাংবাদিকরা সংগ্রহ করেছে ফেসবুক থেকে। একইভাবে ফেসবুকের মাধ্যমেই গুলশানে হামলাকারী সন্ত্রাসীদের পরিচয় জানা গেছে। সামাজিক মাধ্যমেই মডেল সাবিহার মৃত্যুর খবর আসে। (যে কোন পরীক্ষার ফাঁস হওয়া প্রশ্ন খুঁজছেন? জাস্ট ক্লিক করুন) সামাজিক মাধ্যম এতই শক্তিশালী যে , প্রতিটি সংবাদমাধ্যমই এখন একটি একাউন্ট বা পেইজ খুলছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কেবল বিনোদন এর মাধ্যম নয়, এর সঙ্গে এখন সরাসরি যুক্ত সংবাদমাধ্যম, রাজনীতি এবং গণমিথস্ক্রিয়া।

প্রতিটি ফেসবুক একাউন্ট একেকটি সংবাদমাধ্যম বা নিউজমিডিয়া। প্রতিটি টুইটার একাউন্ট একটি সংবাদমাধ্যম বা নিউজমিডিয়া। একটি ব্লগ মানে একটি নিউজ ওয়েবসাইট। একটি ইউটিউব চ্যানেল ক্ষেত্রবিশেষ একটি টেলিভিশন চ্যানেলের থেকে শক্তিশালী। এই ইউটিউবই অখ্যাত হিরো আলমকে মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার আরাধ্য করেছে। এই ইউটিউবই একজন পথ শিশু জাহিদকে দেশ কাঁপানো তারকা করেছে। মেইনস্ট্রিম মিডিয়া তারকা বানানোর যে মনোপলি ভোগ করতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সেই মনোপলি ভেঙে দিয়েছে। এ এক নির্মম সত্য। ইন্টারনেটের অমিত শক্তি প্রচলিত সব কিছুকে বিনির্মাণ করছে। ডিকনস্ট্রাকশনের এমন জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ আর একটাও নেই।

কারো পুরো ফেসবুক পোস্টটাই কলাম হিসেবে প্রকাশিত হচ্ছে পত্রিকা বা অনলাইন পোর্টালে। ব্রিটিশ প্রোপাগাণ্ডা মিডিয়া বিবিসি তো সরাসরি ফেসবুক কমেন্টকে মন্তব্য হিসেবে চালিয়ে নিউজ করে। যদিও বিবিসির সংবাদগুলো নিউজ হয় না কোন ব্যক্তিগত মত প্রকাশ পায় তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। বিবিসির আকবর হোসেনদের ব্যবহৃত ‘অনেকেই মনে করেন’, ‘বিশ্লেষকরা বলছেন’, ‘একজন ভুক্তভোগী বলেন’ শব্দগুলো এখন মানুষ বিশ্বাস করেনা। কারণ এই শব্দগুলো যে আকবর হোসেনরা নিজে তা আমরা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছি। একদিন এটা নিয়ে আলাদা আলোচনা করবো।(সেন্টমার্টিন্স যাওয়ার আগে এই ভিডিওটি দেখে যাবেন। আপনার হৃদয়কে নাড়া দেবেই) 

ফেসবুক এবং অন্যান্য সোস্যাল মিডিয়ার গুরুত্ব বেড়ে যাওয়ায় এটি ব্যবহারেও সতর্ক হতে হবে। মনে রাখতে হবে ফেসবুক একটি লিখিত দলিল। আর স্ক্রিনশটের ভয়াবহতা তো আছেই। তাই কখন কি তথ্য প্রকাশ করবেন তা ভেবে করবেন। আবার অনেক কঠিন তথ্যও চমৎকার শব্দ ব্যবহার করে সুন্দরভাবে প্রকাশ করা যায়। ৫৭ ধারা বলবৎ আবার! সোস্যাল মিডিয়া এসে নাগরিক সাংবাদিকতা ধারনাটিকে বাস্তব করেছে। আপনার ফেসবুক টাইমলাইন আপনার মিডিয়া। এটি ব্যবহার করে আপনার আশেপাশের সমস্যা, হুমকি, উদ্ভাবন, প্রতিভা, সৃজনশীলতা, অনুপ্রেরণাকে তুলে ধরুন। মেইনস্টিম্র সাংবাদিকদের চেয়ে একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী কোন অংশে কম না। শুধু পোস্টটি পাবলিক করে দিন, সঙ্গে জুড়ে দিন ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট একটি সহজলভ্য হ্যাশট্যাগ। ব্যস, আপনি একটি নিউজ করলে। আপনিও সাংবাদিকতায় যুক্ত হলেন।

নয়া মিডিয়ার যুগের ডিজিটাল সাংবাদিকতায় আপনাকে স্বাগতম। এই সাংবাদিকতাকে আমি মঈনুল রাকীব বলে থাকি ‘সোস্যাল মিডিয়া জার্নালিজম’। সোস্যাল মিডিয়া ইজ নট আনসোস্যাল। এটা পুরো সোস্যাইটিকে ঝাঁকি দিতে পারে। ব্যাখ্যা ও অনুসন্ধানী দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে আশেপাশে চেয়ে দেখুনতো সংবাদযোগ্য কত কিছুকেই আপনি এতদিন খেয়াল করেননি। (ফুলকুচি বা টেঁটা দিয়ে মাছ কোপানো দেখতে ক্লিক করুন) ঝটপট স্মার্টফোনটিতে ভিডিও করে বা ছবি তুলে, দুই চারটি কথা লিখে পোস্ট করুন। ঘাবড়ে যাবেন না সংবাদের পরিভাষা হচ্ছে কি না এটা ভেবে। আমরা প্রচলিত সংবাদের পরিভাষা বিনির্মাণ করবো। সংবাদ নিরাবেগ রোবোটিক করার দিন শেষ। সংবাদ হবে সত্য, সুন্দর ও পাঠোপযোগী। সেটি করতে আপনার সৃজনশীলতাকে কাজে লাগান।

এই ইন্টারনেটের যুগে সত্য মিথ্যা যাচাই করতে সোস্যাল মিডিয়াকে কাজে লাগান। নানা মত, পথ ও ব্যক্তিত্ত্বের মানুষের সঙ্গে নেটওয়ার্ক গড়ে তুলুন। শুধু চ্যাট করতে সোস্যাল মিডিয়ায় না এসে এটিকে উৎপাদনশীল করুন। দেখবেন, সোস্যাল মিডিয়া একটি সাম্যবাদী আবহাওয়া দিচ্ছে। পুঁজিবাদী আগ্রাসন, ভোগবাদ ও অপপ্রচারকে রুখে দিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে যতটা সম্ভব ব্যবহার করুন।

যদিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের রাজনৈতিক অর্থনীতি খুবই কলঙ্কজনক। কাশ্মীরের মুক্তিকামী জনতার ছবি, সংবাদ ও্ প্রতিবাদ ফেসবুক থেকে ডিলিট হয়, ফিলিস্তিনের মানুষের অধিকার বিষয়ে কথা বললে তা ফেসবুক, গুগল সরিয়ে ফেলে। (মুজিব বাহিনী ও গণবাহিনীর উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধুর দুষ্প্রাপ্য একটি ভাষণের ভিডিও এখানে) বাংলাদেশের মানুষের ফেসবুক একাউন্ট বিনা নোটিশে গায়েব করে দেয়। এসবের পাশাপাশি সোস্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে হুমকি-ধামকীও কম হয়না। চলে নিউজ প্রোপাগাণ্ডা। সেসব ব্যাপারে সতর্ক থেকে সোস্যাল মিডিয়া ব্যবহার করতে হবে। প্রত্যেকটি জিনিসের সীমাবদ্ধতা থাকে। সোস্যাল মিডিয়ারও আছে। আশা করি একদিন জুকারবার্গসহ অন্যান্য সোস্যাল মিডিয়ার কর্ণধারদের পুঁজিবাদী ও ক্ষমতার অনুগত থাকার মানসিকতা দূর হবে। ইন্টারনেট হবে সত্যিকার সাম্যবাদী একটি প্লাটফরম।

সোস্যাল মিডিয়া ও সাংবাদিকতা হোক মানুষের জন্য। মেইনস্ট্রিমের আধিপত্য আরো বেশি চূর্ণ হোক। কারণ মেইনস্ট্রিমের মালিক গুটিকয়েক সমাজচ্যূত ভোগবাদী পুঁজিবাদী ব্যবসায়ী। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মালিক প্রতিটি একাউন্ট হোল্ডার। যত বেশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম জনপ্রিয় হবে, মানুষের কাছে পেীঁছে যাবে, তত বেশি মেইনস্ট্রিমের প্রলেতারিয়েত তথা নিম্নবিত্তবিরোধী অবস্থান নড়বড়ে হবে। গরীবের, ক্ষমতাহীনের, বঞ্চিতের কথা বলার মাধ্যম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। মূলধারার খবরদারি একদিন এই মাধ্যমের হাতেই শেষ হবে, এটাই আমার বিশ্বাস।
(২০১৮ তে একটু পরিমার্জিত। ২৫ এপ্রিল, ২০১৭ তে লিখিত)

লেখক:
মঈনুল রাকীব, স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।                                                   
পাঠ অনুভূতি