‘মা‘ পৃথিবীর সবচেয়ে মধুর শব্দ। মহাবিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়স্থল। মা মানে ভরসা, মা মানে আশা, মা মানে পৃথিবীর একমাত্র ব্যাংক যা কোনদিন দেউলিয়া হয়না। মায়ের চেয়ে বড় ‘শিক্ষক’ জগতে দ্বিতীয়টি নেই। মা হচ্ছে প্রাণ। দুনিয়ার একমাত্র নিঃস্বার্থ ভালবাসা, বন্ধন ও মায়ার সম্পর্ক মা ও সন্তানের সম্পর্ক। পৃথিবীর প্রত্যেকটি ধর্মে মায়ের সর্বোচ্চ স্থান দেওয়া হয়েছে। সেই মা নিয়ে আজ ফেসবুকে ভীষণ তোলপাড়! কর্পোরেট পৃথিবীতে মায়ের জন্য একটি দিবস দিয়ে মায়ের জন্য বৃদ্ধাশ্রমে একটি ছোট খাটেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে। অথচ মা থাকার কথা মাথায়, মা থাকার কথা হৃদয়ের একেবারে গহীনে, মা থাকবে জীবনের প্রতিটি কাজের মধ্যে। মাতৃভক্তি আল্লাহ, ঈশ্বর, ভগবানের নিকটবর্তী হওয়ার সবচেয়ে নিশ্চিত ও প্রতিষ্ঠিত মাধ্যম। অথচ মায়ের প্রতি কেমন যেন উদাসীন এই পৃথিবী। বেহেশতে যাওয়ার দ্বার মা ও বাবা এই ব্যক্তিকেন্দ্রীক ভোগবাদী পৃথিবীতে কিভাবে যেন হয়ে গেলো ‘বোঝা’ এবং সহস্র অসভ্য প্রত্যেকদিন জন্ম নিচ্ছে মায়েরই গর্ভে যারা এই ধারণা পোষণ করে যে, ‘মা বাবা বৃদ্ধাশ্রমে যত্নে থাকলে সেটিই ভাল’। আহা, কেবল নিজের ও নিজের স্বামী বা বউয়ের জন্য ছোট্র সংসারে মজামাস্তি করতে চাওয়া অপপ্রজন্ম কিভাবে ভাসিয়ে দিচ্ছে টাইমলাইন মায়ের প্রেমে, অথচ তাদের মানসিক প্রস্তৃতি মা-কে কিভাবে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানো যায়। অথবা মায়ের সঙ্গে চিল্লিয়ে, ঝাড়ি দিয়ে, গালি দিয়ে, ছোট করে ছাড়া কথাই বলেনা যে সেও বিরাট মাতৃপ্রেমী আজ।
২।
মহানবী (স) এর কাছে একবার জনৈক সাহাবী এসে প্রশ্ন করলেন,‘হে আল্লাহর রাসূল, আমার কাছ থেকে উত্তম ব্যবহার পাওয়ার সবচেয়ে বেশি দাবিদার কে?’
মহানবী মুহম্মদ (স) বললেন,‘তোমার মা’
সাহাবী বললেন,‘তারপর?’
মহানবী স বললেন,‘তোমার মা’
সাহাবী তৃতীয়বার জানতে চাইলেন,‘তারপর কে?’
মহানবী স এবারও বললেন, ‘তোমার মা’
চতুর্থবার সাহাবী বললেন,‘তারপর কাকে?’
মহানবী স বললেন,‘তোমার বাবা।’
...
...
এই হচ্ছে ইসলাম ধর্মে মায়ের মর্যাদা। তিনগুণ বেশি মর্যাদা মায়ের। মহানবী স বলেছেন, মায়ের পায়ের নিচের সন্তানের বেহেশত। অর্থাৎ আপনাকে বেহেশতে যদি যেতে হয় তবে ঐ মায়ের পায়ের তলা দিয়েই যেতে হবে। আপনার বেহেশতের চাবিকাঠির মনে কষ্ট দিয়ে বেহেশতে যাওয়ার আশা কইরেননা। বিএফ আর জিএফ আর হাবি বা বেবি নিয়ে ব্যস্ত থেকে মায়ের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে যতই শুক্রবার গিয়ে মসজিদে মাথা ঠুনাঠুনি করেন কোন লাভ হবেনা। আল্লাহ ঘোষণা দিয়েই মায়ের হাতে আপনার আমার বেহেশতে যাওয়ার টিকেট ধরিয়ে দিয়েছেন। আমাদের মায়ের সেবা করে সেই বেহেশত আদায় করতে হবে। আটা ময়দা মেখে, চুলে স্পাইক করে ‘আম্মু, তুমি চুপ করো, তুমি বুঝবানা’ ইত্যাদি বলে মাকে কষ্ট দেয়া বা বউ পেয়েই ফ্ল্যাট নিয়ে আলাদা হওয়াদের বেহেশত কিন্তু মসজিদে না, কোন মোল্লা বা পীর সাহেবের কাছেও না।
নিজের মায়ের পায়ের তলায় বেহেশত। এত কাছে বেহেশত রেখেও যদি সন্তান বেহেশতকে সন্তুষ্ট না করতে পারে তার প্রতি আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল অভিশাপ বর্ষণ করেছেন। ইসলাম ধর্মের একাধিক গ্রন্থে রয়েছে, যে ব্যক্তি তার পিতামাতা, বা শুধু পিতা বা শুধু মাতা এর যেকোন একজনকেও জীবীত পেয়েও বেহেশত আদায় করতে পারলোনা তার জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কোন কৃপা থাকবেনা।মা কষ্ট পেলে আল্লাহর আরশ ব্যথিত হয়। মায়ের দোয়া বিদ্যুৎ বেগে কবুল হয়। আমাদের এলাকায় শামসুল হ ফরিদপুরী (র) নামের এক পীর ছিলেন। মা-বাবার কাছে শুনছি, উনার জন্য মুরিদরা খাবার নিয়ে আসলে উনি বলতেন,‘ওরে পাগল, তোর ঘরে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় পীর রয়েছে। এই খাবার তারে দে। তার হক নষ্ট করলে জীবনযৌবন সব তোর শেষ হযে যাবে রে।’ তো আমরা কতটুকু নিশ্চিত করেছি ঘরের মধ্যে থাকা জান্নাতের দ্বারদ্বয়ের সন্তুষ্টির ব্যাপারে? বিএফ, জিএফ, হাবি, বেবি কখন যে নিজ নিজ স্বার্থে হাবিজাবিতে পরিণত হবে তার কোন গ্যারান্টি নেই, কিন্তু মা ও বাবা নিজের কিডনি বা প্রাণটা দিয়ে হলেও আপনাকে আমাকে বাঁচাতে পাশে থাকবে। আমার মা এই বয়সেও নানীকে ছেড়ে কোথাও থাকেননা। প্রেসার মাপা, সারা রাত জেগে থাকে, ইনজেকশান দেয়া, হাইপো হলে সেই রাতে হাসপাতালে নেয়া, মাসে মাসে হাজার হাজার টাকা চিতিৎসা ও ঔষুধ কিনতে খরচ তো রয়েছেই। না ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে এই এক মায়ের জন্য আরেক মায়ের চোখের নিচে কালি পড়েছে। আমি মা-কে বলি, ‘মা, তোমার বেহেশত আল্লাহ দেবেন-ই দেখো। এমন মায়ের সেবা এই দুনিয়ায় আর নেই। তুমি অনন্যা।...’। যাহোক, আপনি খোঁজ নেন সেই মায়ের? মহানবী স বলেছেন, আল্লাহকে ছাড়া কাউকে সিজদা করার অনুমতি দেওয়া হলে তারা হতেন মা ও বাবা। সেই মা ও বাবার প্রতি শ্রদ্ধাপোষণে, তাদের ভরণপোষণে অনীহা বা কার্পণ্য করা মানে নিজের জীবনবৃক্ষের মূল নিজেই কেটে দেওয়া। নিজের কপাল নিজেই স্থায়ীভাবে পোড়ানো। নিজের এইকাল ও ঐকাল উভয়ই বরবাদ করা।
৩।
সনাতন ধর্ম হচ্ছে একটি মাতৃভক্তির ধর্ম। মা ছাড়া এই ধর্ম নিঃস্ব। মনু সংহিতায় রয়েছে:
উপাধ্যায়ান দশাচার্য্য আচার্য্যণাং শতং পিতা
সহস্রন্ত্ত পিতৃন্মাতা গৌরবেণাতিরিচ্যতে
এরমানে দশজন উপাধ্যায় থেকে একজন আচার্য উত্তম, শত আচার্যের চেয়ে পিতা উত্তম এবং হাজার পিতার চেয়ে মাতা সম্মানীত। আরেক জায়গায় আছে:
ইমং লোকং মাতৃভক্ত্যা অর্থাৎ মাকে ভক্তি করে এই দুনিয়া জয় করা যায়। সত্য না? দুনিয়ার প্রত্যেকটি সফল মানুষের ইতিহাস ঘাঁটুন। তার মা ভক্তিই তার সাফল্যের মূল। মায়ের এমন মূল্য এ ধর্মে রয়েছে। জননী ও জন্মভূমিকে সনাতনধর্মে স্বর্গের চেয়ে গরিয়সী বলা হয়েছে। এ কারণেই সনাতন ধর্মেরই বিখ্যাত গায়ক নকুল বিশ্বাস কাঁদতে কাঁদতে গেয়েছেন:
‘খাওয়াইয়া ক্ষীর দধি দুগ্ধ
মাটির মা-কে করছো মুগ্ধ
আরে জ্যান্ত মা তোর ঘরে বসে পঁচা পান্তা খায়
স্বর্গ পুড়ে ছাই হবে রে আমার মায়ের বেদনায়।’
মা মানে স্বর্গ। জ্যান্ত মা হচ্ছে সবচেয়ে বড় দেবী। আজকে মুসলমান সমাজের যে অধঃপত এর কারণ মাতৃভক্তিতে তারা হিন্দু ভাইদের চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে বলেই আমার বিশ্বাস। হিন্দু পরিবার খুঁজে দেখলে দেখা যাবে কি পরিমাণ মাতৃভক্তি সেখানে রয়েছে। পরিবারগুলো এখনো যৌথ। বউ ঘরে এনেই পৃথক হয়ে যাওয়ার কোন তাড়া নেই। তবে এটাও সত্য অনিয়ন্ত্রিত ভোগবাদ মুসলমান সমাজের মত হিন্দু সমাজেও আত্মকেন্দ্রীক মাতৃভক্তিহীন ও হীনাদের জন্ম দিচ্ছে সমানহারে। তো এই মায়ের প্রতি ভালবাসা যেন একদিনে বন্দি না থাকে ভাই বা বোন। মা-ই সব। মা অসন্তুষ্ট হলে কেঁপে উঠবে আল্লাহর আরশ, পুড়ে যাবো সবগুলো স্বর্গ।
৪।
বৌদ্ধ ও খ্রীষ্ট ধর্মে মায়ের মর্যাদা রয়েছে সর্বাধিক। গৌতম বৌদ্ধ, শীলবতী উপাসিকাকে এই পৃথিবীতে সফল হওয়ার বার্তা দিয়েছেন। মায়ের প্রতি কোন ধরনের অভক্তি গৌতম বুদ্ধের মতে নির্বাণ লাভকে বাধাগ্রস্ত করে। অথচ এই বৌদ্ধের নাম মাত্র উপাসনা করা বর্মী ভিক্ষগুলো কিভাবে রোহিঙ্গা মা-হত্যায় নেতৃত্ব দিলো! আহারে বৌদ্ধ, তোমার অহিংসা পরম ধর্মকে কিভাবে লুণ্ঠন করে মানুষ খুনে মত্ত বার্মিজ অসভ্যরা।
ইহুদীরা মাতৃভক্তিতে অনন্য। এবং ইহুদী ধর্মমতে কেবল মাত্র মায়ের রক্তধারা দিয়েই খাঁটি ইহুদি চিহ্নিত করা হবে। অর্থাৎ কোন ইহুদী নারী অন্য ধর্মের কাউকে বিয়ে করলেও সেই গর্ভজাত সন্তানকে ওরা ইহুদী হিসেবে গ্রহণ করবে। এ কারণেই লেলিনকে ইহুদীরা তাদের সন্তান বলে। ইহুদীরা ইউরোপ ও আমেরিকাকে মায়ের প্রতি উদাসীন করে রাখলেও অবৈধ ইসরাঈল জুড়ে মায়েদের প্রতি পৃথক যত্ন নেওয়ার ব্যানার-পোষ্টার টানানো।
খ্রীষ্টান ধর্ম যে, মৌলিক বিশ্বাসের উপর দাঁড়িয়ে আছে সেই ট্রিনিটি বা ত্রিত্ত্ববাদের মাতৃভক্তি উজ্জ্বল। মাতা মরিয়ম বা মেরির প্রতি ভক্তি মানে মায়ের প্রতিও ভক্তি। দুঃখের বিষয় হলেও সত্য এই খ্রীষ্ট সমাজেই সর্বাধিক মা-কে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোর প্রবণতা। ইহুদীবাদী যান্ত্রিক সভ্যতা এত বেশি মানুষকে বস্তুবাদী করেছে যে, ঘর থেকে নিজের স্বর্গ বা জান্নাত বা হেভেনকে যে তাড়িয়ে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিচ্ছে এই স্বাভাবিক বিবেচনাবোধই লোপ পেয়েছে! এমন কি ঘৃণ্য ও অসভ্যদের মত মা ও নারীজাতির প্রতি অবমাননাকর পর্ণগ্রাফিতে মা কে উপস্থাপন করা হচ্ছে নেতিবাচকভাবে। মায়ের প্রতি এমন অপমান ও অপদস্থ করা পশ্চিমা সভ্যতা ধ্বংস হলো বলে! নারীবাদ নামের পুঁজিবাদের দাসীতত্ত্ব কিছুতেই এই পর্ণগ্রাফির ব্যাপারে কথা বলেনা। এটা বন্ধ করার কথা বলেনা। বৃদ্ধাশ্রমের বিরুদ্ধে কোন কথা বলেনা। কারণ এই ভোগবাদী পশ্চিমা ফেমিনিজম মূলত আমাদের নারী তথা মায়ের প্রতি ভক্তিকে হ্রাস করার লক্ষে কাজ করছে। কারণ মায়েদের শরীরকে পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করে উপার্জন করছে এই পুঁজিবাদী শকুনেরা। দুঃখ হচ্ছে, মায়ের জাতির একটি অংশ কোন পর্যালোচনা ছাড়াই পশ্চিমা ইহুদীবাদী মানববিধ্বংসী এসব তত্ব চর্চা করছে। আমাদের এখনই সতর্ক হতে হবে পশ্চিম থেকে আসা এই সব বাজে জিনিসের ব্যাপারে।
৫।
এতক্ষণের আলাপ-আলোচনা ও কথাবার্তার মূল কথা, মায়ের সম্মান-মর্যাদা দিতে যেন আমরা ভুল না করি; যেন আমরা ভুলে না যাই; যেন আমরা মায়ের পায়ের নিচের জান্নাতের কথা স্মরণে রাখি। মা মানে জান্নাত, মা স্বর্গ, মা-ই হেভেন। মায়ের চোখের জলে ডুবে যেতে পারে এই সভ্যতার অট্রালিকা, মায়ের বুকের আহাজারিতে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে এই যুগের সকল যান্ত্রিক অর্জন, মায়ের অনাহারে থাকা হাহাকারে পুড়ে যেতে পারে পৃথিবীর সমস্ত উপাসনালয়, পার্লামেন্ট, জাতিসংঘের অঙ্গসংস্থা। মা যদি কষ্ট পায় তবে দুনিয়া ও পরকাল সব পুড়ে ছারখার হবে। মা যদি কষ্টে উঁহু বলে তবে আল্লাহর আরশ পর্যন্ত সে খবর পেয়ে যায়। সেই মা-কে সম্মান করতে হবে। সেই মায়ের সেবা করতে হবে। মা-কে কোনভাবেই কষ্ট দেয়া যাবেনা। সারাদিন একবার হলেও নিজের মায়ের খোঁজ নিন। মা থাকতে মায়ের মূল্য বুঝুন। হাত ছাড়া হয়ে গেলে বুক চাপড়ে কাঁদলেও পাবেননা। গাইতে হবে চিৎকার করে
‘. এমন দরদী ভবে কেউ হবেনা আমার মা...’
পৃথিবীর সকল মায়ের মঙ্গল হোক। মহানপ্রতিপালক রোহিঙ্গা, সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, কাশ্মীর, ইউক্রেন, ফিলিস্তিন, ফিলিপাইনের মায়েদের সন্তানহারা কান্নায় যেন কবে পৃথিবী ধ্বংস করে দেন সেই ভয় লাগে। ভাল থাকুক বাংলাদেশের সকল মা। আপনার মা-ই আপনার ধর্ম। মাকে খুশি করুন। আল্লাহও খুশি হবেন।মায়ের সাথে দিনে একবার হলেও কথা বলুন। মায়ের মুখের দিকে তাকান। মায়ের আঁচলের সান্নিধ্য ছাড়া পৃথিবীর কোথাও আপনি শান্তি পাবেননা...! আবার বলছি, বিএফ, জিএফ, হাবি, বউ-বেবি মুহূর্তের মধ্যেই স্বার্থে টান পড়লে হয়ে যাবে হাবিজাবি, কিন্তু মা কোনকালেও আপনাকে ছেড়ে যাবেনা। যেখানেই যান কেবল নিজের মায়ের দোয়াটুকু সাথে নিয়ে যাবেন। নিশ্চিত থাকুন আপনি হবে ভীষণ সম্মানীত, ভীষণ গৌরবান্বিত, ভীষণ সফল। আল্লাহর উপর বিশ্বাস রেখে মা-কে ভক্তি করুন, সারা পৃথিবী আপনার ভক্ত হয়ে যাবে দেখবেন, যাবেই।


0 Comments