সর্বশেষ

সমাজতন্ত্র বা মার্ক্সবাদ বা কমিউনিজম: অজনপ্রিয়তা ও পতনের কারণ

কমিউনিজমের পতন বা অজনপ্রিয়তার কারণ
…...................................................


সারা বিশ্বে মার্ক্স আর এঙ্গেলসের কমিউনিজমের পতনের বা অজনপ্রিয়তার মূল কারণ এটি জনতার কল্যাণ করতে চেয়েছে জনতাকে দূরে রেখে, গণবিচ্ছিন্ন থেকে। মার্ক্স বা এঙ্গেলস বা তাদের তাত্ত্বিক সন্তান লেনিন সমাজের নিচু শ্রেণিকে বিপুলভাবে আলোড়িত করতে পারেনি যতটা পেরেছিল সমাজের শিক্ষিত, পাঁতি বুর্জোয়াঁ বা বুর্জোয়াঁদের। সে কারণে ১৮৪৮ এ লণ্ডনে বসে 'কমিউনিস্ট ম্যানুফেস্টো' লিখিত হলেও তা ব্রিটেনে কোন কালে বাস্তবায়নের সম্ভাবনাও জাগেনি। জার্মান হেগেলীয় দর্শন থেকে প্রভাবিত হলেও জার্মানিতেই সবচেয়ে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে কমিউনিজম। এমন কী হিটলারের মত নৃশংস লোককেও সাধারণ জার্মানরা কমিউনিস্টদের থেকে বেশি যোগ্য মনে করে নির্বাচিত করেছে। আর কমিউনিজমের অন্যতম উদ্দীপনা ফরাসী বিপ্লব হলেও আজ পর্যন্ত সেখানেও কমিউনিজম প্রতিষ্ঠিত হয়নি এবং হবে এর কোন আলামতও নাই। এখনকার অনেকে না জেনে মার্ক্সবাদকে তাবৎ বিশ্বের শ্রমিক শ্রেণির উপযোগী বললেও লেনিনের ভাষ্যমতে,  মার্ক্সবাদ কার্যত "মানবজাতির শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি" জার্মান দর্শন, ব্রিটিশ অর্থনীতি ও ফরাসী বিপ্লবের ন্যায়সঙ্গত উত্তরাধিকার (মার্ক্সবাদ, লেনিন, পৃষ্ঠা -৩৪, উৎস পাবলিশার্স, ২০১৪)। "মানবজাতির শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি" ? কী কচু করেছে এরা দুনিয়ায় খুন, দখল, লুটতরাজ ও সন্ত্রাসবাদের সম্প্রসারণ ছাড়া? চিন্তা করা যায়, কী বর্ণবাদী প্রবণতা হৃদয়ে থাকলে এমন বলা যায়! এই হচ্ছে কথিত বিপ্লবী লেনিনের বক্তব্য যার 'শ্রেষ্ঠরা' যে বছর কোটি মানুষ হত্যা করা শুরু করছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ লাগিয়ে তখন লিখেছিল সে, ই.লেনিন ছদ্মনামে। এর বছর তিনেক পর ১৯১৭ সালে অক্টোবর বিপ্লব নাম দিয়ে সেও রক্তের বন্যা বইয়ে দেয় রাশিয়ায়, ট্রটস্কি প্রমুখ ইহুদীকে সঙ্গে নিয়ে।

২।
তো পশ্চিমের এই বর্ণবাদী ফসল কেন প্রাচ্যে ফলাতে চায় অনেকে? মার্ক্স ও এঙ্গেলস তো ইসলাম, বুদ্ধমত, বেদান্ত বা চৈনিক দর্শন সম্পর্কে অতোটা জ্ঞাত নয়। বাংলার প্রাচীন জনপদের শাসনব্যবস্থা বা নালন্দা, সোমপুর বিহার, সোনারগাঁও ইত্যাদি এর বাসিন্দাদের উদ্ভাবনী শক্তি বা ক্ষমতা বা শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে মার্ক্সের অজ্ঞতা কেন আলোচিত হয়না? পশ্চিমের নিজেদের শ্রেষ্ঠ ভাবার আরেকটা 'চাল' নয় কমিউনিজম? পুঁজিবাদের হাত থেকে মুক্তির কথা বলা মার্ক্স সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে নেতিবাচক কিছুই বলেনি, বরং সাম্রাজ্যবাদের প্রতিরোধী শক্তি জাতীয়তাবাদকে ছোট করতে চেষ্টা করেছে।  অন্যদিকে ১৮৪৮, ১৮৮২, ১৮৮৩ সালে প্রকাশিত কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর ভূমিকায় ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূয়সী প্রশংসা করলেও (ইউরোপীয় প্রলেতারিয়েতের উদ্বৃত্ত অংশ আমেরিকা নিচ্ছে বলে এঙ্গেলস উল্লেখ করেন) উত্তর আমেরিকায়ও সাধারণকে আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হয় (কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার, মার্ক্স-এঙ্গেলস, পৃষ্ঠা-১৩, সংঘ প্রকাশন, ২০১৪)। অথচ এঙ্গেলস ও মার্ক্সের দৃষ্টিতে সবচেয়ে বেশি বুর্জোয়াঁর ঘাঁটি ছিল রাশিয়ায় (প্রাগুক্ত), আর রাশিয়ায়ই হলো সবচেয়ে বড় বিপ্লব! কথিত অক্টোবর বিপ্লব! বিপ্লবের নামে কোটি কোটি সাধারণ জনতাকে হত্যা করা হলো এমন কী লেনিন ঘোষণা দিল,'প্রতি ১০ জনের ৯ জনের রক্ত ঝরাতে হলেও বিপ্লব সফল করতে হবে" (The Red Terror in Russia,1975)! কী জঘন্য! বর্বর! এভাবেই কমিউনিজমভিত্তিক রাষ্ট্রের উদ্ভব!  তবে শিল্প বিপ্লবের ফসল হিসেবে একান্ত পশ্চিম ইউরোপীয় এই বিষয়টি কেন রাশিয়ায় গিয়ে হাজির হলো আমি আজো এর কূল-কিনারা খুঁজে বেড়াচ্ছি! আমার লিখিত বই 'বিশ্বায়ন, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও গণমাধ্যম : বহুমাত্রিক প্রভাব-প্রতিবয়ান'-এ এ বিষয়ে একটি ক্রিটিক্যাল আলাপ আছে।

৩।
কথায় ফিরে আসি। কেন কমিউনিজম অজনপ্রিয় হলো?
কারণ কমিউনিজম 'কমিউন' তথা 'সাধারণের' আবেগ, অনুভূতি, বিশ্বাস, ধর্ম, প্রথা, পরিবার, সংস্কৃতিকে উচ্ছেদ করতে চেয়েই ধৃষ্টতা করেনি, প্রতিনিয়ত  এসবকে অসম্মানও করেছে। কারণ মার্ক্স বস্তুবাদী ছিল। ইহুদী হওয়ায় খ্রীস্ট ধর্মের প্রতি বিদ্বেষও হয়তো ছিল। আর মার্ক্সের এই বিদ্বেষ বিশ্বব্যাপী সব কমিউনিস্টদের ধর্মের প্রতি বিদ্বেষী করে তোলে। আর এ বিদ্বেষ ইসলামের প্রতি বেশি হয় কারণ ইসলাম অপেক্ষাকৃত উত্তম নিজস্ব উৎপাদনব্যবস্থা ও শাসনব্যবস্থা নিয়ে কমিউনিজমকে পরাজিত করছিল বা লড়াইয়ের রসদ যোগাচ্ছিল। আরেক ইহুদী ডারউইন মার্ক্স ও এঙ্গেলসকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে। প্রায় প্রতিটি সংস্করণে তাই এঙ্গেলস লিখতেন '...ডারউইনের মতবাদ জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যা করেছে, আমার মতে এই সিদ্ধান্ত ইতিহাসের বেলায় তাই করতে বাধ্য (কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার, মার্ক্স-এঙ্গেলস, পৃষ্ঠা-১৮, সংঘ প্রকাশন, ২০১৪)। এ কারণে তাদের কাছে 'আত্মা বা স্পিরিটের' মূল্য বা ভ্যালু ছিলনা। তারা এর অস্তিত্বই অস্বীকার করতো। এই দিক দিয়ে আধুনিক পুঁজিবাদ ও মার্ক্সবাদ একে অপরের গর্ভে পতিত হয়। মার্ক্স ও পুঁজিবাদ উভয়েই 'পুঁজি বা মুনাফা" নিয়েই ভাবে। পুঁজিবাদ ব্যক্তিকে খাওয়ায়, আর মার্ক্সবাদ কমিউনিস্ট পার্টিকে। উভয়-এ মানুষকে উৎপাদনের যন্ত্রই ভাবে। নিজের সাথে বুর্জোয়াঁদের এই সাদৃশ্যের কারণে কমিউনিস্ট ম্যানুফেস্টোতে মার্ক্স-এঙ্গেলস বুর্জোয়াদের উত্থানের প্রশংসা করতে ভুল করেনি। কারণ দুজনেই এসেছে ঐ বুর্জোয়া পরিবার থেকে। এঙ্গেলসের পিতা টেক্সটাইল ব্যবসায়ী আর মার্ক্সের পিতা আইনজীবী! এমন কী তারা কৃষক-ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের 'রক্ষণশীল বা প্রতিক্রিয়াশীল' ইত্যাদি বলে  (কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার, মার্ক্স-এঙ্গেলস, পৃষ্ঠা-৩৮-৩৯, সংঘ প্রকাশন, ২০১৪) অবজ্ঞা করতেও ছাড়েনি। কতটুকু অর্বাচীন ও গণবিচ্ছিন্ন  চিন্তা করলে কেউ এ সভ্যতার কারিগরকে নিয়ে এমন নিকৃষ্ট কথা বলতে পারে কেউ? তাই পৃথিবীর নিম্নবর্গের কাছে কমিউনিস্ট বা কমিউনিজম আজো যেতে পারেনা। এ প্রকৃত প্রলেতারিয়েতের চেয়ে মার্ক্সের দৃষ্টিতে যন্ত্রশিল্পে, কারখানায় কাজ করা, অফিসে কাজ করা, ট্রেনে যাতায়াত করারা উৎকৃষ্ট প্রলেতারিয়েত বিপ্লবী (কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার, মার্ক্স-এঙ্গেলস, পৃষ্ঠা-৩৬-৩৭, সংঘ প্রকাশন, ২০১৪)! এই সংকীর্ণ ভাবনা নিয়ে জনতার কাতারে কীভাবে আসবে কমিউনিস্টরা? বুর্জোয়াদের মহিমান্বিত করে মার্ক্স-এঙ্গেলস লেখেন,"ইতিহাসের দিক থেকে বুর্জোয়াঁ শ্রেণি খুবই বিপ্লবী ভূমিকা নিয়েছে'(কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার, মার্ক্স-এঙ্গেলস, পৃষ্ঠা-৩৩, সংঘ প্রকাশন, ২০১৪)। মার্ক্সের মতে, এই বিপ্লবী ভূমিকা সামন্তবাদের পতন ইত্যাদি অথচ শিল্প-যন্ত্র-সাম্রাজ্যবাদের উদ্ভবের সঙ্গে বুর্জোয়াঁদের উদ্ভবের সম্পর্ক নিয়ে কিছু লেখেনি তারা।

৪।
বিয়ে সম্পর্কে এ দুজনের ধারণা খুবই জঘন্য। তাদের ভাষ্যমতে, বিয়ে করে নারীকে উৎপাদনের হাতিয়ার বানায় বুর্জোয়াঁ সমাজ, তাদের ব্যক্তিগতভাবে ভোগ করা হয়। এই একক ভোগ্য নারী যাতে সাধারণের তথা সকলের ভোগ্য না হতে পারে সে জন্য কমিউনিজমের সমালোচনা করে বিদ্যমান কমিউনিস্ট বিরোধীরা (কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার, মার্ক্স-এঙ্গেলস, পৃষ্ঠা-৪৫, সংঘ প্রকাশন, ২০১৪)। কী অসুস্থ ভাবনা! বিয়ে যে নৈতিকতা, সম্পর্ক তৈরি ইত্যাদি কারণে হতে পারে এই সাধারণ বোধ কি মার্ক্স-এঙ্গেলসের ছিলনা? এই কথা বলে প্রাচ্যের কোন দেশে এই আদর্শ টিকবে? টেকেওনি! কৃষক ও নিম্নবর্গকে প্রলেতারিয়েতের খাতা থেকে বাদ দেয়া কমিউনিজম তাই বিশ্বব্যাপী শ্রমিকদের হৃদয়ে ন্যূনতম জায়গাও পায়নি। সমাজের সুবিধাবাদী পাঁতি বুর্জোয়াঁ বা পূর্ণ বুর্জোয়াঁ-ই বিশ্বব্যাপী কমিউনিজমের নেতৃত্ব দিয়েছে বা এখনো দিচ্ছে। বাংলাদেশের দিকে তাকালেও দেখবেন ভাসানী ছাড়া সমাজের সুবিধাবাদী ও ভোগবাদী শ্রেণীটিই কমিনিস্ট হয়েছে প্রথম দিকে। বদরুদ্দিন উমর, সিরাজুল, ফরহাদ, বারাকাত, সলিম, সেলিম,মণি, মোজাফফর, ইনু, মেনন, বাদল প্রমুখ আজো প্রলেতারিয়েত তথা সাধারণের কাছে হিরো আলমের চেয়েও অপরিচিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দায় যারা কমিউনিস্ট হওয়ার দীক্ষা নেয় একেবারে শেষে গিয়ে তারাও কর্পোরেট কোন প্রতিষ্ঠান বা বিদেশ বা আওয়ামী লীগ বা বিএনপি-ই হয়! এইটাই এদেশের বামপন্থীদের করুণ পরিণতি। আর অন্যান্য দেশেরও একই দশা। কারণ আদর্শের গোঁড়ায়-ই রয়েছে বিশাল গলদ! কারণ সংস্কৃতি মানুষের জ্বালানি ও শিকড়। শিকড় অস্বীকার করে স্থায়িত্ব পাওয়া যায়না। গ্রামের কৃষক বা রিকশাওয়ালা 'মামা, চাচা বা ভাই' ডাকে বেশি অনুপ্রাণিত হয়, 'কমরেড' শিকড়হীন বুর্জোয়াঁ গন্ধ ছড়ায়樂।

৫।
অথচ সাধারণের বিশ্বাস, স্বাধীনতা, সংস্কৃতির প্রতি সম্মান রেখে সম্পদের সুষম বণ্টন করার আন্দোলন করলে তা এমন মুখ থুবড়ে পড়ার কথা না! যে তত্ত্ব মানুষের বিশ্বাস, আবেগ, প্রথা ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা রাখেনা সে তত্ত্ব কিছুতেই টেকেনা। সে জন্যই চতুর পুঁজিবাদ খুবই চাতুর্যের সঙ্গে আমাদের সংস্কৃতি, আবেগ, বিশ্বাস ইত্যাদি নিয়ে বিজ্ঞাপন বানিয়ে আমাদের পণ্য ক্রয় করায় অথবা পণ্য বানায়। অন্যদিকে পুঁজিবাদের গর্ভজাত সন্তান অসংজ্ঞায়িত অপূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্র, উদারতাবাদ, নারীবাদ ইত্যাদি আমাদের মানবিক মূল্যবোধ ও নীতির জন্য হুমকি তৈরি করে প্রতিনিয়ত। সে বিষয়ে আরেক দিন কথা হবে। আজ অনেক রাত হয়েছে। রাতে বেশি জটিল ভাবনা ঘুমের মধ্যে জটিলতা তৈরি করবে। সেহরি খেয়ে দুনিয়ার মজদুর সব এক হয়ে ঘুমান। 
(আমার রাজনীতিতত্ত্ব ভাবনা-১)
পাঠ অনুভূতি

Post a Comment

2 Comments

  1. অসাধারণ। আমি মুগ্ধ।

    ReplyDelete
    Replies
    1. আপনাকে ধন্যবাদ। অনুগ্রহ করে শেয়ার করুন ও মানুষকে জানার সুযোগ করে দিন।

      Delete