সর্বশেষ

বরগুনার খুন: অমানবিক প্রত্যক্ষদর্শী, বিচারহীনতা ও গণপ্রতিক্রিয়া


সংবাদে আমরা যে প্রত্যক্ষদর্শী লিখি (বা ছাত্রছাত্রীদের পড়াই) তার চাক্ষুষ প্রমাণ! ধরুন, আরেক প্রত্যক্ষদর্শী ভিডিও না করলে বরগুণা প্রতিনিধি যে বক্তব্য ঢাকায় পাঠাতো সেখানে এদের কেউই বর্ণনা দিতো! তাদের সেই বয়ান আবার প্রতিনিধির নিজস্ব বয়ানে মিশতো, সেই বয়ান আবার শব্দ স্বল্পতার কারণে হয়তো সব জায়গাও পেতোনা, কিন্তু আমরা এ ঘটনার সংবাদ পেতাম। সেই সংবাদ পড়ে বা এ বিষয়ক আউট অব ভিশন বা ইনভিশন দেখে আমাদের গণপ্রতিক্রিয়া এমন হতোনা, আমরা পাতা উলটে বা রিমোট টিপে বা ক্লিক করে অন্য নিউজে চলে যেতাম। কিন্তু আমাদের সকলের মনোজগতে প্রবলভাবে কীভাবে এই বরগুণার খুন জায়গা করে নিলো? ভিডিও এর কারণে। আমরা এমন একটি জগতে বাস করছি যেখানে সব কিছু দর্শন বা 'ভিজুয়ালাইজড' না হলে বিশ্বাস জাগেনা, এমন কী সম্পাদিত ভিডিও অনেক সময় 'এগুলো এডিট করা যায়' বলে নাকচ করার চেষ্টা দেখা যায়। সে কারণে অসম্পাদিত, খাঁটি বা র (Raw) ফুটেজের ভীষণ গুরুত্ব রয়েছে বিশ্বাস তৈরি করতে বা সম্মতি উৎপাদন করতে। আর এই র ফুটেজ ছড়িয়ে দিচ্ছে ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটারের মত বিকল্প বা অল্টারনেটিভ মিডিয়া। 

এখান এই যে লোক ভিডিও করেছে তার ও এইসব প্রত্যক্ষদর্শীর মধ্যে তফাৎ আছে কী? অনেকের কাছে নাই। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই গোপনে ভিডিও করা ব্যক্তি ও তা সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার মানসিকতা ঐ দাঁড়িয়ে থাকাদের সমান নয়। ভিডিওকারী এখানে নাগরিক সাংবাদিক। তার কারণেই ঐ খুনীদের চিহ্নিত করা গেছে। করা না গেলে আইন-আদালতের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যেতো। ভিডিও থাকায় তা সম্ভব নয়। আবার মূলধারার মিডিয়া সংবাদ ও সংবাদের শক্তিশালী সূত্র হিসেবে যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ব্যবহার করছে এটি আবারো প্রমাণিত হলো। মূলধারাকে আগামীর পৃথিবীতে এই ফেসবুক-ইউটিউবের কাঁধে সওয়ার হয়ে হয়তো বেঁচে থাকতে হবে।

কিন্তু তাই বলে রিফাতকে খুন করা গোপনে ভিডিও করা ভিডিওকারী আর পুরোনো ঢাকায় বিশ্বজিৎকে প্রকাশ্যে খুন করা প্রকাশ্যে ভিডিও করা অর্ধশতাধিক সাংবাদিক নামধারী কি এক? না, কিছুতেই না। বিশ্বজিৎকে হত্যার আগে সংবাদ বানানোর জন্য অনেক আগে থেকে সেখানে ক্যামেরা তাক করে দাঁড়িয়ে ছিল টিভি বা পত্রিকায় 'সহিসংতা বিক্রি করে' জীবীকা নির্বাহ করা একপাল সাংবাতিক ও তাদের ক্যামেরামানবেরা। তারা নিখুঁতভাবে তা ভিডিও করলো, অথচ হাতে বুম নিয়ে পিছনে ক্যামেরা রেখে অন্যায়ের প্রতিবাদ জানালে পুলিশেরও বুক কাঁপে, আর তো সেই সন্ত্রাসীরা! কিন্তু কেউ বিশ্বজিৎকে বাঁচাতে এলোনা! বিশ্বজিৎ পুরো বাংলাদেশের মানুষের সামনে কোপ খেয়ে 'আমি হিন্দু, শিবির না' বলেও পার পেলোনা!


তারপর ২০১৯ সালের ২৬ জুন রিফাত নামের বিশ্বজিৎ আবার কোপ খেতে খেতে মরলো। এবার প্রত্যক্ষদর্শী নামের বিবেকহীনের সংখ্যা দেখে আমরা হতবাক, কারণ এবারের ভিডিওকারী উপর থেকে আমাদের ওয়াইড এংগেল দিয়ে দেখিয়েছে! বিশ্বজিৎ আর রিফাতদের এভাবে কুপিয়ে মারা কীভাবে সম্ভব? সম্ভব। ঘূণে ধরা বিচারব্যবস্থা থাকলে সম্ভব। 


নারায়নগঞ্জের সাত খুনের কথা মনে আছে? সেই খুনী তারেক, নূর হোসেনদের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের পরোয়ানা কি আজকে জারি করেছে আদালত? কই তাদের ফাঁসি হয়না কেন? কীসের দায়? কথায় কথায় স্বপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করা আদালত তার রায় কার্যকর না করার মাধ্যমে লঙ্ঘিত অপরাধ কেন বিবেচনায় নেয়না? খুব হতাশাজনক ব্যাপার।


ঐ শিশু রাজনকে যে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করলো তাদের ফাঁসি কে দেবে? নির্লজ্জ উকিলদের টাকার কাছে বিবেক বেচে পেশাদারিত্ব এর কাঁধে বন্দুক রেখে আর কত সন্ত্রাসী, খুনী ও ধর্ষকদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে অপরাধ ও অপরাধীকে জিইয়ে রাখবে?


তনু হত্যার বিচার? নুসরাত হত্যার বিচার? শীর্ষ সন্ত্রাসী জোসেফ কই? রানা প্লাজার খুনী রানা? খুনী এমপি শাওন? খুনী এমপি পুত্র কই? সাগর-রুনীর খুনীরা কই? এদের বিচার হয়েছে? হয়নি। তবে নিরপরাধ একরামকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে খুন করা হয়েছে। এ ঠাণ্ডা মাথার খুনের বিচার হয়েছে? 


এই বিচারহীনতার সংস্কৃতি খুনীদের আগাম ইন্ডেমনিটি দিচ্ছে। তারা জানে পার পেয়ে যাবে আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে। তারা জানে রাজনৈতিক ব্যাক আপ আছে। তারা জানে বেহায়ার মত টাকা খেয়ে তাদের পক্ষে ওকালতি করার জন্য আইঞ্জীবী নামের ছোটলোকের দল আছে যারা স্বাধীনতা বিরোধিতা করা খুনীদেরও আইনী সেবা দিয়েছে। তারা জানে মিডিয়া টাকাওয়ালাদের দালালী করছে, নতুন কোন ঘটনায় আবার মনোযোগ দেবে। রিফাতের স্ত্রী মিন্নির দিকে অনেকে আঙ্গুল তুলছে অনৈতিক জীবনযাপনের জন্য। একেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হোক। 


এতসব হতাশার মধ্যে আলো নিয়ে আসে সোস্যাল মিডিয়া বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেখানে মানুষ অন্তত এক হয়ে প্রতিবাদ জানাতে পারে, এক হয়ে অন্যায়কে অন্যায় বলতে পারে। ফেসবুক বাংলাদেশে প্রেক্ষাপটে জনমত তৈরিতে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আবার এই ফেসবুক সন্দেহ, সংশয় বা গুজবও সৃষ্টি করছে। তবে সেই গুজব স্থায়ী হচ্ছে এটা কেউ নিশ্চয়তা দিতে পারবেনা, কিন্তু এই গুজব বা অর্ধসত্য সংবাদ, মিথ্যা সংবাদ বা পোস্ট বা স্ট্যাটাস গণসংশয়ী ও গণঅবিশ্বাসী প্রবণতারও জন্ম দিচ্ছে। এ কথা অবশ্য ইউটিউবের ক্ষেত্রে কম খাটে। কারণ এখানে প্রধান আধেয় ভিডিও যা সহজে মিথ্যায় রূপান্তরিত করতে সকলেই পারেনা।

যা বলছিলাম, প্রত্যক্ষদর্শী। এতগুলো মানুষ রিফাতকে রামদা নিয়ে কোপানো দেখছিল। কারো কোন ভাবনা চিন্তা নাই। রিফাতের স্ত্রী নিম্মি একা-ই লড়াই করে যাচ্ছিল স্বামীকে রক্ষা করতে, রিফাত চাইলেই পারতো দৌড়ে জীবন রক্ষার চেষ্টা করতে কিন্তু সে লড়াই করেছে। দাঁড়িয়ে থাকাদের মধ্যে থেকে সবাই যদি হৈ দিতো তবুও ভয় পেতো ঐ সন্ত্রাসী নয়ন ও ফরাজী। কিন্তু জানোয়ার দুইটা একটা মানুষকে রাম দা দিয়ে কোপাচ্ছিল আর অমানুষ, অসভ্যরা তা দেখে পৈশাচিক সুখ পাচ্ছিল। এটাই মূল্যবোধের অবক্ষয়ের করুণ উপস্থিতি। 


একটা সময় সমাজে ঘুষখোর, সুদখোর, মাস্তান, গাঁজাখোর, মালে ভেজাল দানকারী, টেন্ডারবাজ, দুর্নীতিবাজ, চাঁদাবাজকে ঘৃণার চোখে দেখা হতো। এখন এদের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা দেয়া হয়েছে। রাজনৈতিক কারণে বা শিক্ষার অভাবে মূল্যবোধের অবক্ষয়কে সমাজে ভালভাবে জায়গা দেয়া হয়েছে। এখন ঘুষ-লোপাট-দুর্নীতিকে 'আউট ইনকাম' বলে মেনে নেয়া হয়েছে। এখন সন্ত্রাসী কার্যক্রম বা নেশাখোরদের নেতা কাছে টেনে নিচ্ছে। এই অপরাধীদের বিচার করতে ব্যর্থ হচ্ছে প্রচলিত বিচারব্যবস্থা, তাই ক্রশ ফায়ারের মত বিচারহীন খুনকেও অনেক সময় জনগণ সমর্থন করছে। রিফাতের খুনী নয়ন ও ফরাজির ক্রশফায়ার চাচ্ছে অনেকে। এই চাওয়ার যৌক্তিকতা রয়েছে, কারণ আদালতের উপর জনতার ভরসা নাই। কিন্তু ক্রশফায়ারের জনপ্রিয়তা আবার বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে এমনভাবে ভাত-মাছ করেছে যে ক্রশফায়ার ব্যবসা করে তারেক সাঈদরা নিরপরাধ মানুষ হত্যা করে, একরামরা 'আল্লাহ' বলতে বলতে মারা যায় অকালে!


তাই রিফাতের খুনীদের দ্রুত বিচার করতে হবে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে দিতে হবে। এই শাস্তির গুরুত্ব রয়েছে। যে অনাস্থা এই দেশের আদালত ও নির্বাহী বিভাগের উপর জনতার এসেছে তা থেকে দেশ ও জাতিকে উদ্ধার করতে হলে স্বচ্ছ ও দ্রুত বিচার করতে হবে রাষ্ট্রের। দুষ্টের দমন ও শিষ্টের লালন বহুদিন ধরে বিপরীত অবস্থায় আছে। একে মানবিক ও সত্যের আলোয় উদ্ভাসিত করে সুশাসন ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত না করা হলে খুন, রাহাজানি, নৈরাজ্য লাল-সবুজ পতাকাকে খামচে ধরবে। নাকি ইতোমধ্যেই ধরেছে?
পাঠ অনুভূতি

Post a Comment

0 Comments