কিছু কথা
আমাদের চারপাশে দৈনিক অনেক ঘটনা ঘটে, অনেক ছবি তোলা হয়। কিন্তু সব ছবি গল্প বলার জন্য উপযুক্ত নয়। আবার অজস্র ছবির মধ্যে কোনটি কাঙ্খিত ছবি তাও সহজে বের করার উপায় নাই। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা, অধ্যয়ন, অনুশীলন আমাদের সংবাদমাধ্যম উপযোগী ছবি তোলায় পারদর্শী করে তোলে। আলোকচিত্র বা ছবি সাংবাদিকতায় একটি ছবির গুরুত্ব অপরিসীম। সে কারণে ছবি তোলার বিষয়ে বিস্তর সময় দেয়ার প্রয়োজন। সময়, শ্রম ও সৃজনশীলতার সমন্বয়ে একটি চমৎকার সংবাদযোগ্য ছবি পেয়ে থাকি। সংবাদের সঙ্গে থাকা প্রতিটি ছবি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া বা পদ্ধতির মাধ্যমে উঠে আসা চেষ্টার বাস্তব রূপ।
সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের চীন শাখার প্রধান (২০১৪ পর্যন্ত থাইল্যান্ড শাখার প্রধান ছিলেন) বসনিয়ার নাগরিক আলোকচিত্রী দামির সাগোলজ (Damir Sagolj) সংবাদযোগ্য ছবি তোলার জন্য সাতটি পরামর্শ দিয়েছেন। দামির একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিত্রসাংবাদিক। তিনি বসনিয়ার যুদ্ধ কাভার করে সবার নজরে আসেন। তারপর ৯/১১ হামলা, আফগানিস্তানে মার্কিন আগ্রাসন, ইরাকে মার্কিন ধ্বংসযজ্ঞ, পাকিস্তানের বন্যা, ফিলিপাইনের মাদক, অলিম্পিক গেমস, মিয়ানমারের সন্ত্রাসবাদীতা ও অন্যান্য পরিবর্তন, বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ক্যাম্প ইত্যাদি নিয়ে ছবি তুলেছেন। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি আন্তর্জাতিক প্রেস ফটো পুরস্কারসহ অনেক সম্মাননা পেয়েছেন।
বর্তমানে তিমি রয়টার্সের চীন শাখার প্রধান চিত্র সাংবাদিক হিসেবে কাজ করছেন। ১৯৭১ সালে বসনিয়ার রাজধানী সারায়েভোতে জন্ম নেয়া এ জাত আলোকচিত্র সাংবাদিক তাঁর দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে ছবি সাংবাদিকতা বিষয়ে কিছু মূল্যবান পরামর্শ দিয়েছেন। তার এ পরামর্শগুলো কোন আলোকচিত্রী বা ছবি সাংবাদিক বা ফটো জার্নালিস্ট অনুসরণ করলে কারো সংবাদযোগ্য ছবি খুঁজে পেতে বেগ পেতে হবেনা। দামিরের পরামর্শকে আমি আমার ছাত্রছাত্রীদের জন্য বিস্তৃত রূপ দান করেছি। ভবিষ্যতে অন্য কারো এতে উপকার হলে আমার শ্রম সার্থক হবে।
![]() |
রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্সে প্রকাশিত দামিরের ছবি |
বর্তমানে তিমি রয়টার্সের চীন শাখার প্রধান চিত্র সাংবাদিক হিসেবে কাজ করছেন। ১৯৭১ সালে বসনিয়ার রাজধানী সারায়েভোতে জন্ম নেয়া এ জাত আলোকচিত্র সাংবাদিক তাঁর দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে ছবি সাংবাদিকতা বিষয়ে কিছু মূল্যবান পরামর্শ দিয়েছেন। তার এ পরামর্শগুলো কোন আলোকচিত্রী বা ছবি সাংবাদিক বা ফটো জার্নালিস্ট অনুসরণ করলে কারো সংবাদযোগ্য ছবি খুঁজে পেতে বেগ পেতে হবেনা। দামিরের পরামর্শকে আমি আমার ছাত্রছাত্রীদের জন্য বিস্তৃত রূপ দান করেছি। ভবিষ্যতে অন্য কারো এতে উপকার হলে আমার শ্রম সার্থক হবে।
দামির সাগোলজের সপ্তপরামর্শ
রয়টার্সে কর্মরত দামির সাগোলজ চিত্রসাংবাদিকতাকে হৃদয়ে ধারণ করেন। ছবি দিয়ে দর্শকের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য তিনি প্রতিনিয়ত ছুটে বেড়ান। তাই তিনি ছবি তোলায় আগ্রহীদের জন্য বা ছবি সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্তদের জন্য কিছু মূল্যবান ভাবনাকে সাতটি পৃথক বিন্দুতে চিহ্নিত করেছেন। দামির সাগোলজ বর্ণিত ৭ টি পরামর্শ নিম্নরূপ:
১। মুহূর্ত আঁচ করা বা পূর্বদর্শন (Anticipate the moments you want to capture)
২। ক্লিকের আগে গবেষণা (Research before clicks)
৩। গন্তব্যে পৌঁছানো (Reach Out)
৪। গুরুত্বানুযায়ী অগ্রাধিকার বোঝা (Understanding Prioritise)
৫। প্রতিক্রিয়া-মিথস্ক্রিয়া বন্দিকরণ (Capturing Interaction)
৬। অদৃশ্য হওয়া (Be Invisible) এবং
৭। অধিক অনুশীলন (Practice More and More)
(তথ্যসূত্র: রয়টার্স থমসন ফাউন্ডেশনের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল। ভিডিও শিরোনাম : 7 Photojournalism tips by Reuters Photographer Damir Sagolj)
নিচে এ সপ্তপরামর্শ সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করা হলো।
১। আঁচ করা (Make your Anticipation)
কোন ছবি তোলার আগে একজন আলোকচিত্র সাংবাদিককে তা নিয়ে বিস্তর ভাবতে হবে। এতে করে আগে থেকে কী তুলতে হবে, ঠিক কোন মুহূর্তকে ক্যামেরাবন্দী করতে হবে তার ব্যাপারে একটি পূর্বধারণা হৃদয়ে গেথে থাকে। এতে করে অজস্র মুহূর্ত থেকে কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত পেতে একটুও বেগ পেতে হয়না। কিন্তু আগে থেকেই যদি কী ছবি তুলবো, কোথায় গিয়ে তুলবো, কোন মুহূর্ত বন্দি করবো এ ব্যাপারে ধারণা না থাকে তবে অনেক সুন্দর মুহূর্ত বা সংবাদযোগ্য ছবি তাৎক্ষণিক ভাবতে ভাবতে চোখের সামনে দিয়ে হারিয়ে যেতে পারে। এ কারণে ছবি তোলার আগে থেকে ছবি নিয়ে ভাবতে হবে, পূর্ব থেকেই নিজের ছবিকে কল্পনায় নিয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে এবং অবশ্যই ছবির বিষয়, স্থান, মূহুর্ত নিয়ে একটি সার্বিক চিত্র মস্তিষ্কের মধ্যে আঁকতে হবে। হ্যাঁ, তাৎক্ষণিক অনেকেই ছবি তুলতে পারেন, কিন্তু যে কাজটি আগে ভেবে করা হয় তার সঙ্গে তাৎক্ষণিক করা কাজের পার্থক্য আপনি ধরতেই পারবেন চোখের পলকে। আর ব্যতিক্রম কখনো উদাহরণ হবেনা এটাও আমাদের স্মরণ রাখা উচিত।
২। মানুষ, রাজনীতি, প্রকৃতি, ক্যামেরা নিয়ে গবেষণা (Research on People, politics, Culture, nature and Camera
একটি ভাল কাজ পেতে হলে তাতে সময় দিতে হয়। সেটি নিয়ে অনুসন্ধান চালাতে হয়। গবেষণা করলে দারুন সব ফল আসতে পারে। ছবি তোলার এই এই গবেষণা একাডেমিক গবেষণার মত এই গৎবাঁধা নিশ্চয়ই হবেনা। ছবির গবেষণা ছবির মতই অল্পতে অনেক করা। কী নিয়ে ছবি তোলা হবে অর্থাৎ ছবির বিষয়বস্তু, ছবির চরিত্র, ছবির স্থান বা প্রাকৃতিক দৃশ্য, ছবি তোলার ঝুঁকি, ছবি তোলার ক্ষেত্রে আইনী ঝুঁট ঝামেলা আছে কী না ইত্যাদি নিয়ে অধ্যয়ন করতে হবে। আবার এ ধরনের ছবি আগে কেউ তুলেছে কী না, তুললে সেগুলো দেখে সেখান থেকে অভিজ্ঞতা অর্জনের পাশাপাশি সেসব ছবির সীমাবদ্ধতা নিয়ে ভাবতে হবে। কী কী অনুপস্থিত সেসব ছবিতে যা একজন দর্শক দেখতে চায় বা যা নতুন কোন ভাবনার উদ্রেক ঘটায় তা গবেষণা করে বের করে ছবি তুলতে যেতে হবে। কোন জায়গা রাজনৈতিক বা সামাজিক কারণে ঝুঁকিপূর্ণ হলে সেই এলাকার মানুষের সঙ্গে আগে পরে সাংবাদিক বা গণমাধ্যমের সম্পর্ক কেমন তা নিয়ে আগেই ধারণা নিতে গবেষণা জরুরি।
যেমন, আপনি ভারতে গেলেন গোরক্ষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত সাম্প্রদায়িকদের ব্যাপারে ছবি তুলতে, অথচ তারা যে ভয়াবহ নৃশংস হয়ে আপনাকেও হত্যা করতে পারে ভারতের পুলিশের সামনেও তা আপনি জানলেন না। ফলে বিপদ হতে পারে। আবার চীনের উইঘুর মুসলমানদের দুর্দশা তুলে ধরতে চীনা সরকারের সাংবাদিকদের উপর নিষেধাজ্ঞা না জেনে আপনি ছবি তুলতে গেলে সঠিক ছবিটি না পাওয়ার পাশাপাশি সরকারি নজরদারির শিকারও হতে পারেন। গবেষণার জন্য ইন্টারনেট, পত্রিকা, টেলিভিশন, পুস্তক ও অন্যান্য গবেষকরা সহায়ক হতে পারেন। আবার কোন লেন্স কখন ভাল, কোন এংগেলে ছবি তুললে ছবি আরো আকর্ষণীয় হতে পারতো ইত্যাদি নিয়েও গবেষণা চালাতে হবে।
যেমন, আপনি ভারতে গেলেন গোরক্ষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত সাম্প্রদায়িকদের ব্যাপারে ছবি তুলতে, অথচ তারা যে ভয়াবহ নৃশংস হয়ে আপনাকেও হত্যা করতে পারে ভারতের পুলিশের সামনেও তা আপনি জানলেন না। ফলে বিপদ হতে পারে। আবার চীনের উইঘুর মুসলমানদের দুর্দশা তুলে ধরতে চীনা সরকারের সাংবাদিকদের উপর নিষেধাজ্ঞা না জেনে আপনি ছবি তুলতে গেলে সঠিক ছবিটি না পাওয়ার পাশাপাশি সরকারি নজরদারির শিকারও হতে পারেন। গবেষণার জন্য ইন্টারনেট, পত্রিকা, টেলিভিশন, পুস্তক ও অন্যান্য গবেষকরা সহায়ক হতে পারেন। আবার কোন লেন্স কখন ভাল, কোন এংগেলে ছবি তুললে ছবি আরো আকর্ষণীয় হতে পারতো ইত্যাদি নিয়েও গবেষণা চালাতে হবে।
৩। গন্তব্যে পৌঁছানো (Reach Out Anyhow)
ধরুন আপনি বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের থানচি এলাকার ছবি তুলবেন। এখানে আপনি কীভাবে যাবেন? সেখানটা একেতো দুর্গম, আবার মিয়ানমার ও ভারতের মদদপুষ্ট পাহাড়ী সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজদের দখলদারত্বের স্পষ্ট ছাপ। কিন্তু আপনার কর্মস্থল আপনাকে এসাইনমেন্ট দিলো থানচি নিয়ে ছবি তোলার, কিংবা আপনি নিজেই এ অঞ্চলের ছবি তুলতে চান। তো আপনি কি দুর্গম বলে যাবেন না? আপনি কি সন্ত্রাসীদের ভয়ে নিজের দেশের একটি জায়গায় ছবি তোলার অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন?
না। দামিরের মতে, আপনি যেভাবেই হোক ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে চেষ্টা করবেন। আপাত দৃষ্টিতে আপনার মনে হবে আপনি সেখানে গেলে কোন সহায়তাকারী পাবেন না। কিন্তু খুবই ধৈর্যের সঙ্গে অপেক্ষা করলে আপনি সেখানের কোন সাধারণের বাড়িতে থাকার মত সম্পর্ক তৈরি করতে পারেন, হয়তো চান্দের গাড়ির চালক আপনাকে তথ্য ও স্থানের অবস্থান জানাবে, হয়তো কোন কলা-ডাব বিক্রেতা, ঝালমুড়িওয়ালা বা গাইড আপনাকে সহায়তা করবে। আপনি বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর সহায়তাও পেতে পারেন। সে কারণে যে গন্তব্যে আপনি যেতে চান ছবি তুলতো যতই প্রতিবন্ধকতা মনে আসুক আপনি পিছু হটবেন না। কাউকে না কাউকে আপনি পাবেনই যে আপনাকে গন্তব্যে পৌঁছে দিতে একই পথের যাত্রী। এমন কী শত্রুদের মধ্যেও এই অদৃশ্য পথসঙ্গীরা নিভৃতে অবস্থান করে। আপনাকে শুধু অপেক্ষা করে খুঁজে নিতে হবে।
না। দামিরের মতে, আপনি যেভাবেই হোক ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে চেষ্টা করবেন। আপাত দৃষ্টিতে আপনার মনে হবে আপনি সেখানে গেলে কোন সহায়তাকারী পাবেন না। কিন্তু খুবই ধৈর্যের সঙ্গে অপেক্ষা করলে আপনি সেখানের কোন সাধারণের বাড়িতে থাকার মত সম্পর্ক তৈরি করতে পারেন, হয়তো চান্দের গাড়ির চালক আপনাকে তথ্য ও স্থানের অবস্থান জানাবে, হয়তো কোন কলা-ডাব বিক্রেতা, ঝালমুড়িওয়ালা বা গাইড আপনাকে সহায়তা করবে। আপনি বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর সহায়তাও পেতে পারেন। সে কারণে যে গন্তব্যে আপনি যেতে চান ছবি তুলতো যতই প্রতিবন্ধকতা মনে আসুক আপনি পিছু হটবেন না। কাউকে না কাউকে আপনি পাবেনই যে আপনাকে গন্তব্যে পৌঁছে দিতে একই পথের যাত্রী। এমন কী শত্রুদের মধ্যেও এই অদৃশ্য পথসঙ্গীরা নিভৃতে অবস্থান করে। আপনাকে শুধু অপেক্ষা করে খুঁজে নিতে হবে।
৪। গুরুত্বানুযায়ী অগ্রাধিকার দেয়া (Understanding Your Priority)
দামির সাগোলজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ হচ্ছে, একজন আলোকচিত্র সাংবাদিক হিসেবে আপনাকে গুরুত্বের ক্রম বুঝতে হবে। কারণ আশেপাশের সব ঘটনার ছবি আপনার সংবাদমাধ্যম চায়না বা চাইলেও প্রকাশের জায়গার সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
আবার তাৎক্ষণিক সামনে আসা কোন ঘটনা, দুর্ঘটনা বা প্রাকৃতিক বা মানবসৃষ্ট দুর্যোগের সব বিষয়ের খুঁটিনাটি ছবি তোলাও সম্ভব নয়। তাই এসাইনমেন্ট হলে কোন বিষয়ের ছবির বেশি চাহিদা বা কোনটির সংবাদমূল্য বা তাৎপর্য বা ঐতিহাসিক গুরুত্ব বেশি সেটি নির্ধারণ করতে হবে। আর তাৎক্ষণিক ঘটা ঘটনায় চটজলদি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতে হবে কোন বিষয়ের ছবির গুরুত্ব অধিক। সেই দিকে বেশি নজর দিতে হবে। যেমন বাংলাদেশে রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় উদ্ধার কাজে সাধারণ মানুষ অনেক সহায়তা করে, সেখানে সেনাবাহিনীও আসে, ফায়ার সার্ভিসও আসে। এখন চিত্রসাংবাদিক হিসেবে আপনাকে ঠিক করতে হবে কোনটিকে গুরুত্ব দিবেন। সাধারণ মানুষের ব্যাপক অবদানকে আপনি উপরে স্থান দিলে সেটিকেই আপনার গুরুত্ব দিয়ে তাদের উদ্ধার তৎপরতার ছবি তোলা উচিত। আবার যে উদ্ধার কাজকে কম গুরুত্ব দিয়ে কেবল হতাহতের ছবিকে গুরুত্ব দিবে তার ক্যামেরা আহত বা নিহত কর্মীদের দিকেই তাক করে রাখার পরামর্শ দামিরের। কারণ একই সঙ্গে একাধিক কাজকে সমান গুরুত্ব দিলে কোনটিই ভাল হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে।
আবার তাৎক্ষণিক সামনে আসা কোন ঘটনা, দুর্ঘটনা বা প্রাকৃতিক বা মানবসৃষ্ট দুর্যোগের সব বিষয়ের খুঁটিনাটি ছবি তোলাও সম্ভব নয়। তাই এসাইনমেন্ট হলে কোন বিষয়ের ছবির বেশি চাহিদা বা কোনটির সংবাদমূল্য বা তাৎপর্য বা ঐতিহাসিক গুরুত্ব বেশি সেটি নির্ধারণ করতে হবে। আর তাৎক্ষণিক ঘটা ঘটনায় চটজলদি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতে হবে কোন বিষয়ের ছবির গুরুত্ব অধিক। সেই দিকে বেশি নজর দিতে হবে। যেমন বাংলাদেশে রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় উদ্ধার কাজে সাধারণ মানুষ অনেক সহায়তা করে, সেখানে সেনাবাহিনীও আসে, ফায়ার সার্ভিসও আসে। এখন চিত্রসাংবাদিক হিসেবে আপনাকে ঠিক করতে হবে কোনটিকে গুরুত্ব দিবেন। সাধারণ মানুষের ব্যাপক অবদানকে আপনি উপরে স্থান দিলে সেটিকেই আপনার গুরুত্ব দিয়ে তাদের উদ্ধার তৎপরতার ছবি তোলা উচিত। আবার যে উদ্ধার কাজকে কম গুরুত্ব দিয়ে কেবল হতাহতের ছবিকে গুরুত্ব দিবে তার ক্যামেরা আহত বা নিহত কর্মীদের দিকেই তাক করে রাখার পরামর্শ দামিরের। কারণ একই সঙ্গে একাধিক কাজকে সমান গুরুত্ব দিলে কোনটিই ভাল হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে।
৫। প্রতিক্রিয়া-মিথস্ক্রিয়া বন্দিকরণ (Capturing Interaction)
ছবির প্রাণ হচ্ছে এর বিষয়ের প্রতিক্রিয়া। মানুষের চোখের দৃষ্টি, হাতের ঈশারা, পায়ের অবস্থান ইত্যাদির সমন্বয়ে যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া-মিথস্ক্রিয়া আসে তাকে ছবিতে ফুটিয়ে তোলাই একজন আদর্শ সাংবাদিকের কাজ। সে কারণেই জীবনের এই সূক্ষ্ম অনুভূতি থেকে প্রকাশ্য আচরণ ক্যামেরাবন্দী করার চেষ্টা করে যেতে হবে। প্রকৃতির ক্ষেত্রেও তার গতিশীলতার পাশাপাশি নীরবতা বা শূন্যতার মধ্যে যে বার্তা আছে তা তুলে ধরার মাধ্যমে ভাল ছবি আসতে পারে। কোন একজন যুদ্ধ বিধ্বস্ত মানুষের কপালে হাত দেয়া মুহূর্ত সহস্র শব্দের চেয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। আবার যুদ্ধের কারণে ভাঙাচোরা পরিত্যাক্ত একটি নগরের চিত্র তার প্রতিক্রিয়া ফোটাতে পারে। ২০১৭ এ রোহিঙ্গা সংকটের সময়ে পিঠে ছোয় ভাইকে নিয়ে কাদাভরা দুর্গম পথে নাফ নদী পাড়ি দেয়া এক শিশুর সংগ্রাম ভীষণ নাড়িয়ে দিয়েছিল আমাদের। আবার ক্যামেরা তাক করে রাখাকে বন্দুক ভেবে হাত উঁচু করে দেয়া এক সিরিয়ান শিশুর প্রতিক্রিয়া বন্দি করা জার্মান ফটোগ্রাফারের ছবিটি আমাদের হৃদয়ে আজো নাড়া দেয়।
৬। অদৃশ্য হও (Be Invisible)
একজন ভাল চিত্র বা ছবি সাংবাদিকের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য সে হবে তার বিষয়ের থেকে অদৃশ্য! এর অর্থ ছবির বিষয় (Subject, i.e. an worker) যেন কিছুতেই বুঝতে না পারে তার ছবি তোলা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে কৃত্রিম অভিব্যক্তি ফুটে উঠতে পারে। তাই দামির বলেছেন, তিনি যখনই ছবি তুলতে বের হন তখনই এ বিষয়টি মাথায় রাখেন যেন যার ছবি তোলা হচ্ছে সে কিছুতেই বুঝতে না পারে। যদি বুঝে ফেলে বা দেখে ফেলে ক্যামেরা, সেক্ষেত্রেও স্বাভাবিকভাবে নিতে হবে এবং পরবর্তী ক্লিকের প্রত্যাশায় অপেক্ষা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, পৃথিবীর অনেক সেরা ছবিই মূলত ক্যামেরা হাতে থাকা ব্যক্তিটির অদৃশ্যের ক্লিক। তবে কোন পোর্ট্রেট বা ব্যক্তির ছবি তুলতে গিয়ে তার জ্ঞাতসারেই ছবি তোলা হয়। কিন্তু সেখানেও তাকে বলতে হবে, ধরে নিন কেউ নাই। আপনি আপনার মত তাকান। ক্যামেরা মানুষের চোখের মত কাজ করে। তাই এই চোখ দিয়ে নির্মোহ দৃষ্টিতে যা দেখা হয় তা সুন্দর লাগে। আর ক্যামেরা তখনই নির্মোহ হবে যখন তা অদৃশ্যে থেকে ক্লিক করবে।
৭। অনুশীলন (Practice more and more)
আমরা সবাই জানি, গাইতে গাইতে গায়েন...! অর্থাৎ একের পর এক অনুশীলন করলেই পরিশ্রমের ফল সুমিষ্ট হবে। তাই একজন চিত্র সাংবাদিককে কেবল ভাবলেই চলেনা। অনেক বেশি অনুশীলন করতে হয়। ক্লিকের প্রতি কিপটেমি করা যাবেনা। শেখার জন্য অজস্র ক্লিক করে যেতে হবে। চালাতে হবে ক্যামেরার নানা ম্যানুয়াল, লেন্স, শট ইত্যাদি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। এভাবে দিনের পর দিন ছবির সঙ্গে লেগে থাকার পরই একটি সংবাদযোগ্য বা নন্দিত বা ঐতিহাসিক গুরুত্বসম্পন্ন ছবি পাওয়া যায়। আপনি পৃথিবীর একজন চিত্রগ্রাহক বা চিত্র সাংবাদিক পাবেন না যিনি রাতারাতি খ্যাতি পেয়েছেন বা যিনি এক ক্লিকেই খ্যাত হয়েছেন। প্রতিটি ভাল ও নন্দিত ছবির পিছনে অজস্র ফেলে দেয়া ক্লিকের না বলা ইতিহাস রয়েছে। প্রতিটি প্রকাশিত ছবি আসলে অগুনিত ডিলিট হওয়া ছবির ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে। তাই অনুশীলনের বিকল্প নাই। আপনার হাতে মোবাইল ফোন ক্যামেরা, এসএলআর বা ডিএসএলএর (DSLR) যা থাকুক তা দিয়ে ছবি তুলতে থাকুন। গাইতে গাইতে গায়েনের মতই তুলতে তুলতে আপনি যোগ্য চিত্রগ্রাহক বা আলোকচিত্রী বা ছবি সাংবাদিক হয়ে উঠবেন। আপনার জন্য অজস্র শুভকামনা।
সমাপনী বক্তব্য
ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো এর ভাষ্যমতে, দামির সাগোলজ ছবি তোলার উপর কেবল অভিজ্ঞ তা নয়, তিনি এ বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনকারী (Sagolj holds MA in Photojournalism and Documentary Photography from London College of Communication.)। একই সঙ্গে দামিরের রক্তে রয়েছে সাংবাদিকতা, কারণ তাঁর বাবাও একজন সাংবাদিক ছিলেন। সুতরাং একজন ভাল আলোকচিত্রী বা ফটোজার্নালিস্ট বা ফটোগ্রাফার হতে দামিরেরর দেয়া এই কথাগুলোর মূল্য অসীম। আশা করি এই সপ্তকথা অনুসরণ একজন আদর্শ চিত্র সাংবাদিক বিনির্মাণ করবে। তবে ছবিকে দিয়ে কথা বলাতে হলে প্রাণ ও প্রকৃতির সঙ্গে আগে ক্যামেরা পিছনের মানুষটির কথা বলা শিখতে হবে।
চোখে দেখে হৃদয়ের দরদ দিয়ে প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ ও অধ্যয়নই একজন আদর্শ চিত্র সাংবাদিক বা চিত্রগ্রাহক বা আলোকচিত্রী বা ফটোগ্রাফার হিসেবে আপনাকে তৈরি করবে। প্রস্তুত করবে ভবিষ্যতের অমসৃণ পথের দক্ষ পথিক হিসেবে; যে পথিকের হাতে বা কাঁধে থাকবে ক্যামেরা। সে ক্যামেরা কথা বলবে মানুষের, প্রাণের, প্রকৃতির! সে ক্যামেরা গল্প বলবে; ফুটফুটে জীবন্ত গল্প! ছবির গল্পরা শব্দদের স্তব্ধ করে আমাদের হৃদয়-মন আলোড়িত করবে।
লেখক:
মঈনুল রাকীব
প্রভাষক
সাংবাদিকতা, যোগাযোগ ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ।
বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়।
চোখে দেখে হৃদয়ের দরদ দিয়ে প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ ও অধ্যয়নই একজন আদর্শ চিত্র সাংবাদিক বা চিত্রগ্রাহক বা আলোকচিত্রী বা ফটোগ্রাফার হিসেবে আপনাকে তৈরি করবে। প্রস্তুত করবে ভবিষ্যতের অমসৃণ পথের দক্ষ পথিক হিসেবে; যে পথিকের হাতে বা কাঁধে থাকবে ক্যামেরা। সে ক্যামেরা কথা বলবে মানুষের, প্রাণের, প্রকৃতির! সে ক্যামেরা গল্প বলবে; ফুটফুটে জীবন্ত গল্প! ছবির গল্পরা শব্দদের স্তব্ধ করে আমাদের হৃদয়-মন আলোড়িত করবে।
লেখক:
মঈনুল রাকীব
প্রভাষক
সাংবাদিকতা, যোগাযোগ ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ।
বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়।
0 Comments