![]() |
বিপ্লবী ইলা মিত্র। ছবি/ইন্টারনেট |
আমাদের জাতীয়তাবোধহীন গণমাধ্যম ও শিক্ষাব্যবস্থা এমন একটি শিকড়হীন প্রজন্ম তৈরি করছে যারা চেনেনা কে ইলামিত্র, কে প্রীতিলতা, কে তিতুমীর, কে ঈশা খাঁ! এরা জানেনা কার ভয়ে পালিয়েছিল আলেকজাণ্ডার। এরা জানেনা অনার্য পূর্বপুরুষের সংগ্রামগাঁথা, যাদের ভয়ে এই ভূখণ্ডে আর্য বর্ণবাদ টিকতে পারেনি। এরা নিজেদের ইতিহাসের মহিয়সীকে জানেনা। নিশ্চয়ই একদিন ঈশা, তিতুমীর, কাদের সিদ্দিকী, প্রীতিলতাকেও চেনা কষ্টকর হবে আমাদের প্রজন্মের কাছে।
তোমার কোন দোষ নেই ভাইয়া বা আপু। এইটা আমাদের নীতিনির্ধারকদের সংকীর্ণতা যারা দেশের কৃষ্টিকে, ইতিহাসকে ঠিকমতো ছড়িয়ে দিতে পারেনি। এই দায় আমাদের জাতীয়তাবোধহীন গণমাধ্যম ও তার কর্মীদের। অথচ ঠিকই আনুষ্কা কবে কোথায যায়, সানি লিওনের কোথায় তিল রয়েছে, ইমরান খানের বাপ মা কে সব মুখস্ত এদের। কি প্রজন্ম সামনে আসছে রে! এরা লাল সবুজকে কিভাবে ধারণ করবে? এরা বাংলাদেশের হাল কিভাবে ধরবে? আমার কাছে আপাতত এ প্রশ্নের জবাব নাই।
একজন ছোট ভাই ইলা মিত্র কে এটা জানতে চেয়েছে। তার কোন দোষ নেই। কারণ এই সমাজ, এই মিডিয়া, এই পাঠ্যপুস্তক তাতে ইলা মিত্রের মহান সংগ্রাম সম্পর্কে অজ্ঞ রেখেছে। এই জাতীয়তাবোধহীনরা বরং বিরটা কোহলী, আফ্রিদী, টম ক্রুজ, সানি লিওন, শাহরুখ, ট্রাম্পকে বেশি চিনিয়েছে। এই অথর্ব জাতীয়তাবোধহীন পাঠ্যপুস্তকেই তো লুটেরা ক্লাইভের নামের পাশে সম্মানসূচক ‘তিনি’ লেখা হয়, খুনী কর্ণওয়ালিসের ব্যাপারে লেখা হয় ‘প্রবর্তন করেন’। অথচ এগুলোর কারো নামের আগে দখলদার লেখা হয়না। খুনী লেখা হয়না। এগুলো যে বহিরাগত ধান্ধাবাজ লুটেরা তা লেখা থাকেনা।
এরা হাজার কোটি টাকার সম্পদ লুটে, কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ তৈরি করে মানুষ মেরেও নিজেদের স্বার্থে কয়টা রেললাইন করেছে বা কিছু মানসিক দাস তৈরি করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করেছে তাই ভরা থাকে পাঠ্যপুস্তকে। সে কারণেই এই দেশে কোনকালে পশ্চিমা শিক্ষায় বিরাট শিক্ষিতরা কোন আন্দোলন দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতে পারেনি।
বঙ্গবন্ধু ‘আমার গরীব’ বলে যাদের ডাকতেন তাদেরই পূর্বপুরুষ ১৭৫৭ তে লড়াই করছে, তারাই ১৮৫৭ তে গর্জে উঠেছে, তারাই ফকির-সন্নাসী, তাদেরই রক্ত ৫২ তে ঝরেছে, তারাই ১৯৬৯ এ গণঅভ্যুত্থান করেছে এবং ১৯৭০ এ ভোট দিয়েছে নৌকায় আর ১৯৭১ সালে তারাই ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এই বিটিশানুরাগী শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের রক্তের টগবগানিকে ভোগবাদে নিয়োজিত রেখেছে। বিপ্লব ও বিপ্লবীকে এই রক্ত চেনেনা।
শোনো ভাইয়া, ইলামিত্র ব্রিটিশ বিরোধী এক মহানেত্রী। তিনি ছিলেন কৃষকদের আন্দোলনের মধ্যমণি। তাঁর আন্দোলনের নাম তেভাগা আন্দোলন।
এক সময় বাংলার কৃষকের জমিতে তাদের অধিকার ছিল। সেটি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে ব্রিটিশ কুকুরেরা হাতিয়ে নেয়। এর পরের ধাপে আসে দেশীয় জমিদার, জোতদার, তালুকদার, মহাজন নামের ব্রিটিশ দালালদের অত্যাচার। তারা কষ্ট করে চাষ করা জমির ফসল থেকে কিছুই দিতোনা কৃষক বা বর্গাচাষীকে। ইলা মিত্র কৃষকদের নিয়ে জোর গলায় বললেন, এই রক্তচোষা বদমায়েশী আর চলবেনা। কৃষক হচ্ছে উৎপাদনের চালিকাশক্তি। এই ভারতবর্ষ চালায় কৃষক। উৎপন্ন ফসল তিন ভাগে ভাগ করতে হবে। তার দুই ভাগ পাবে ঘাম ঝরিয়ে মাটি থেকে ফসল উৎপন্ন করা কৃষক-শ্রমিক, আর বাকি এক ভাগ পাবে অনুৎপাদনশীল কথিত জমির মালিক ও তার ব্রিটিশ প্রভুরা।
এই আন্দোলন খুব শক্তভাবে দমন করতে দেশীয় পাতি নেতাদের নিয়ে ব্রিটিশ দখলদাররা চেষ্টা করে।
ইলামিত্র হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গাকেও অনেকটা বন্ধ করেছিলেন। কৃষক কৃষকই, সে হিন্দু ও মুসলিম যা হোক। আর অনুৎপাদনশীল শোষক এই মাটি ও কৃষকের শত্রু। এই বোধ শহীদ তিতুমীরের পর ইলা মিত্র ফের জন্ম দিয়েছিলেন। এই মাটিতে কৃষকদের নিয়ে এইভাবে তিতুমীর, বঙ্গবন্ধু প্রমুখও লড়াইয়ে নেমেছিলেন। ইলা মিত্র এক ইতিহাসের নাম। ইলা মিত্র যেন তিতুমীরের লড়াইয়ের একটা অংশ।
ইলা মিত্রকে ভুলে যাওয়া মানে প্রাচ্যকে ভুলে যাওয়া। প্রাচ্য ছাড়া আমি আপনি নাই হয়ে যাবো ভাই!
0 Comments