সংবিধানের ৭(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ। এই প্রজাতন্ত্রী-তে কোন ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা মতের একক আধিপত্য থাকবেনা, কারণ এর মালিক হচ্ছে জনগণ। এ জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে ৫ বছরের জন্য সরকার গঠন করা হয়; রাষ্ট্র বা নয়া প্রজাতন্ত্র নয়। সরকার বা বিরোধী দল, গণমাধ্যম, বুদ্ধিজীবী, কর্মচারী আমলা, নিরাপত্তা বাহিনী বা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কৃষক-শ্রমিকের উৎপাদন সমভাবে বণ্টনের মাধ্যমে একটি সুশৃঙ্খল কাঠামোর মধ্যে নাগরিকদের নিয়ে আসা। সংবিধানের ২৭ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান। দল, মত নির্বিশেষে সবাই ন্যায় বিচার পাওয়ার সাংবিধানিক অধিকার রাখে। ক্ষমতাসীন আর বিরোধী বা পুলিশ বা গোয়েন্দা বাহিনী বা ছাত্রদের কোন রাজনৈতিক দল চাইলেই আইন নিজের হাতে তুলে নিতে পারেনা! কিন্তু সেই আইনের শাসন আছে? গণমাধ্যমের গণবিচ্ছিন্ন কর্পোরেট দাস দাসী এই আলোচনা সবার সামনে আনছে কখনো? সুশাসন নিয়ে এমপিথ্রি আর ওরাকল পড়ে আমলা-পুলিশ-রাজনীতিবিদ হয়ে সুশাসনকে কীভাবে ভুলে যাই আমরা? সংবিধানের ৩৬, ৩৭, ৩৮ অনুচ্ছেদ নাগরিকদের চলাফেরা, সমাবেশ ও সংগঠন করার অধিকার দিয়েছে। বিএনপি-জামায়াত-জাতীয় পার্টি-আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসীন হওয়া সাপেক্ষে প্রতিপক্ষের ছাত্রসংগঠনের কোন কর্মী বা নেতাকে খুন করে ফেলতে পারে? গণমাধ্যম বা সামাজিক মাধ্যম সব জায়গায় এমন একটি আবহাওয়া যে, 'সন্দেহে' মেরেই অন্যায় হয়েছে, 'নিশ্চিত' হয়ে মারলে 'ঠিক' ছিল। কী নিদারুন নিকৃষ্ট ঘৃণাজীবী একটি গণমানস এদেশে গড়ে উঠেছে! কোন সুসভ্য সমাজ বা রাষ্ট্রে এই ধরনের দানবায়ন ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দুর্বৃত্তায়িত করে প্রহার, গ্রেফতার, হত্যাকে গ্রহণযোগ্য মনে করা হয়না। এটি সুবিচার ও আইনের শাসনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী অপচর্চা। গণমাধ্যম, আইন প্রণেতা, মন্ত্রী, আমলা, বিরোধী রাজনৈতিক দল, এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও এই অবস্থার জন্য কম বেশি দায়ি। এরা নিজেদের আখের গোছাতে এতই ব্যস্ত যে, একটি পরমত সহিষ্ণু পরিবেশ তৈরি করতে তাদের না ছিল উদ্যোগ, না ছিল বয়ান-প্রতিবয়ান কিংবা কোন গঠনমূলক প্রস্তাবনা। বরং এসব গোষ্ঠী ও পেশাজীবীরা নিজ সংকীর্ণ স্বার্থে নিজেরাই করে বেড়াচ্ছে মারপিটের রাজনীতি--- অর্থের জন্য, ক্ষমতার জন্য, সুবিধা ও লোক দেখানো মর্যাদার জন্য । এমন কী এখনো তাদের আলাপ এমন যে, কেউ ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, বামপন্থী, নাস্তিক বা শিবির হলে তাকে মারলে 'সমস্যা' ছিলনা, কিন্তু 'সন্দেহ' করে মারা বিশাল 'অপরাধ/অন্যায়' । এই যে কেউ ছাত্রলীগ, শিবির, ছাত্রদল, বাম,ডান, নাস্তিক ইত্যাদি হলেই তাকে মেরে ফেলে দেয়া যায় এই অবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে। এটাই আমাদের সংবিধানের সেই ন্যায় বিচার, ইনসাফ, সাম্যাবস্থা। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে এমন মনে হচ্ছে, এসব সাধারণ বিষয়ও নাগরিকদের জানা নাই, এমন কী গলাবাজ উচ্চশ্রেণির সুবিধাভোগী নাগরিকদেরও না।
সংবিধানের ৩৯ নং অনুচ্ছেদ বাক স্বাধীনতা ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিয়েছে। ১৪৫ এর (ক) অনুচ্ছেদ বলছে, সকল আন্তর্জাতিক চুক্তি যা নিরাপত্তার সঙ্গে স্পর্শকাতর নয় তা জাতীয় সংসদে আলোচনা পর্যালোচনার জন্য পাঠাতে হবে। বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি বা বিভিন্ন সময় এদের সহচর জামায়াত ও বামপন্থীরা আন্তর্জাতিক চুক্তির ক্ষেত্রে কোন দিন এই ধারাকে অনুসরণ করেছে? করতে সরকারকে চাপ দিয়েছে? গণমাধ্যম এ নিয়ে ডিস্কোর্স তৈরি করছে? বিশ্ববিদ্যালয়ের অযোগ্য, অথর্ব, বিবেকপঁচা মাস্টার-মাস্টারনী এ নিয়ে আলাপ তুলেছে? সবাই মূল্যবোধ জলাঞ্জলি দিয়ে যার যার আখের গোছাতে ব্যস্ত। জবাবদিহিতা বলে এই রাষ্ট্রে কিছু কি আদৌ আছে?
অথচ এ রাষ্ট্র ও এর জনগণ কেমন যেন এ সব ধারাকে চেনেনা, জানেনা! আমরা ভুলে যাই, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে ৩০ লক্ষ শহীদ ও ২ লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে আমরা একটি পতাকা পেয়েছিলাম, একটি সংবিধান তৈরি করেছিলাম। আমরা একটি সত্যিকার গণপ্রজাতন্ত্র গঠন করে সাম্য, ন্যায়, ইনসাফ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামো তৈরি করতে চেয়েছিলাম। অথচ আজ আমরা নাগরিক হিসেবে আমাদের কী অধিকার তা ভুলতে বসেছি, আমাদের আত্মকেন্দ্রিকতা দিন দিন নিজেদের অধিকারকে বিস্মৃত করে দিচ্ছে। আমরা ভুলে গিয়েছি আমাদের করের টাকায় আমাদের সেবা করার জন্য একটি আইনসভা, একাধিক আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং জনগণের কর্মচারী আমলা আছে। আমরা আমাদের রক্ষকদের ভক্ষক হিসেবে গ্রহণ করতে নীরবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছি, আমাদের কর্মচারী চাকরকে মনিব হিসেবে মেনে 'স্যার স্যার' করে আমরা গৌরববোধ করছি, আমাদের সংবিধানকে ভুলে আমরা অসাংবিধানিক নানা কসরতের কাছে স্বেচ্ছায় জিম্মিদশা গ্রহণ করেছি। আমরা সম্মিলিতভাবে ভুলে গেছি, আমরা বাংলাদেশের মালিক। আমরা খুব ভালোভাবে ভুলে গেছি আমাদের রাষ্ট্রের সংবিধান ও গঠনতন্ত্রকে। আমরা আগা থেকে গোড়া সবাই 'গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের' রূপরেখা সম্পর্কে অজ্ঞ। আমরা বঙ্গবন্ধু, বিপ্লব, মুক্তিযুদ্ধ, শহীদ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে প্রতিনিয়ত বিশ্বাসঘাতকতা করছি।
এ বিশ্বাসঘাতক, আত্নকেন্দ্রিক চিন্তা-ভাবনা-কর্মের ঊর্ধ্বে উঠতে না পারলে জাতিরাষ্ট্র হিসেবে আমাদের দীর্ঘজীবী হওয়ার সম্ভাবনা ভীষণ কম। বাংলাদেশকে প্রশ্ন করুন। আপনার বিবেকের কাঠগড়ায় দাঁড়ান। কী দেখছেন? কী করছেন? কী ভাবছেন? শিরদাঁড়া আছে ঠিক জায়গায়?
0 Comments