সর্বশেষ

সাংবাদিক হওয়ার যোগ্যতা কী? ন্যূনতম যোগ্যতা নির্ধারণ জরুরি কেন?

বস্তুনিষ্ঠতা চর্চায় সাংবাদিক হওয়ার যোগ্যতা নির্ধারণ জরুরি কেন?
~~~
বস্তুনিষ্ঠতা চর্চায় সাংবাদিক হওয়ার ন্যূনতম যোগ্যতা নির্ধারণ জরুরি কেন?
~~~
তাহলে সাংবাদিকতায় বস্তুনিষ্ঠতা ফিরিয়ে আনতে হলে কী কতে হবে? প্রথমত, সম্পাদককে সাংবাদিকতার উপর পড়াশোনা করা হতে হবে। অন্তত অন্য যেকোনো বিষয়ে পড়ার পরেও সাংবাদিকতা, গণমাধ্যম ইত্যাদি বিষয়ে ডিগ্রিকে সরকার থেকেই বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে।

দ্বিতীয়, ন্যূনতম সাংবাদিকতার উপর কোর্স ছাড়া মফস্বল পর্যন্ত কাউকে এ পেশায় যুক্ত হতে দেয়ার অবাধ সুযোগ বন্ধ করতে হবে। 

তৃতীয়তা, সাংবাদিকতা, যোগাযোগ ও গণমাধ্যম বিষয় থেকে পড়াশোনা করার পরেই এ পেশায় নিয়োগ দেয়া শুরু করতে হবে। এতে করে যে কেউ দুই লাইন লিখতে বা বলতে পারার বাইরেও নীতি, নৈতিকতা, সামাজিক দায়বোধ, জাতীয়তাবোধ, বস্তুনিষ্ঠতা, পরিমিতিবোধ ইত্যাদি সম্পর্কে জানাশোনার প্রয়োজনীয়তাটা উপলব্ধি করতে পারবে।

আমি মনে করি, যেভাবে চিকিৎসক হতে হলে চিকিৎসা বিষয়ে ডিগ্রি, প্রকৌশলী হতে হলে প্রকৌশল ডিগ্রি, আইনবিদ বা বিচারক হতে হলে আইনবিষয়ক ডিগ্রি অর্জন এ রাষ্ট্রে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে সেভাবেই যেকোনো পর্যায়ে (সম্পাদক থেকে ক্যামেরা পারসন) সাংবাদিকতা করতে হলে সাংবাদিকতা, যোগাযোগ ও গণমাধ্যম বিষয়ে ডিগ্রি অর্জনকে বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। কারণ, গণমাধ্যম কাজ করে মানুষের মনস্তত্ত্বকে নিয়ে। 

মানুষের সম্মতি, অসম্মতি উৎপাদনের ভয়ানক সংবেদনশীল বিষয় নিয়ে কাজ করতে হয় সংবাদমাধ্যমকর্মীদের। প্রোপাগাণ্ডা, এজেন্ডা, প্রাইমিং, ফ্রেমিং, কিলিং, ক্রাইম, হাইডিং, সেনসেনালিজম, ক্লিকবেইট---ইত্যাদি বিপজ্জনক বিষয় নিয়ে কাজ করছে এদেশে যারা তাদের একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ডে এ বিষয়গুলোর গুরুত্ব, তা কীভাবে হয়, কেন হয় বা কেন তা বন্ধ করা যায় তা নিয়ে পাঠ নেই। ফলে মেরুদণ্ড সোজা রেখে সব সময় এই সব পরিস্থিতি মোকাবেলা করা যায়না। 

আমার মনে হয়, সাংবাদিকতায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করে আসা ছেলে বা মেয়েদের মেরুদণ্ড সহজেই কিনে নিতে পারবেনা মালিকপক্ষ---যদি একযোগে সব মিডিয়ার ফেয়ার রিক্রুটমেন্ট প্রক্রিয়ায় এরা সুযোগ পায়। আমাদের পিআইবি ইত্যাদি কী করে? 

শিক্ষক নিবন্ধন বা জুডিশিয়ারির মত অন্তত একটি কেন্দ্রীয়ভাবে মূল্যায়ন করা পদ্ধতি চালু করে উত্তীর্ণদের 'সাংবাদিকতা করার অনুমোদন বা যোগ্যতার সনদ' দেয়ার প্রস্তাবনা রাখা যায়। সরকারকে এ বিষয়ে পরামর্শ দেয়ার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সিনিয়র সাংবাদিকদের৷ সাংবাদিকদের অনেকে সাংবাদিকতায় হয়তো ডিগ্রিধারী নন (ডিগ্রি ছাড়া ভালো সাংবাদিকতা করতে পারেন না আমি সেটি বলছিনা। মোনাজাত উদ্দিন ডিগ্রি ছাড়াই ডিগ্রিধারীদের পাঠ্য, আবার নাইমুল ইসলাম খাঁ ডিগ্রি নিয়েও হাস্যকর!), কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতার শিক্ষকরা তো এমন একটি ব্যবস্থা চালু করতে পারতেন? তারা করেন কী? শুধু হাতলে বসা, সেলফি, নকল এবং পশ্চিমের বস্তাপঁচা ১৯২০ এর তত্ত্ব আর ১৯৪৪ এর মার্কিন নির্বাচন মুখস্ত! নাকি?

এ কারণে, যেসব লোকের সাংবাদিকতায় মাঠ পর্যায়ের হাতেখড়ি নেই তাদের সাংবাদিকতার শিক্ষক হওয়া থেকেও দূরে রাখা উচিত। কারণ, শুধু মুখস্তবিদ্যা মাঠ পর্যায়ে এসে প্রয়োগ করা যায়না। যারা সাংবাদিকতা করেইনি, নিউজ বন্ধ করার ফোন পাননি, নিউজ করতে গিয়ে প্রতিবন্ধকতার শিকার হননি---তারা এসব বিষয়কে জয় করার কৌশল কীভাবে শেখাবে? সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যমের বাস্তবতা এখনো আর পঞ্চাশের দশকের মার্কিন নির্বাচনে পড়ে নেই---এটাই অনেক সাংবাদিকতা, যোগাযোগ ও গণমাধ্যমের শিক্ষক/শিক্ষিকার পড়ানোতে বা বুঝে দেখা যায়না।। 

যারা সাংবাদিকতা বিভাগে না পড়েও এই পেশায় আছেন, ভালো করছেন আমি তাদের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি ন্যূনতম একটি বাছাই প্রক্রিয়া ছাড়া এ পেশায় যারা আসে তারা নীতির সঙ্গে আপোষ করার ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। কারণ, অনেক ক্ষেত্রেই তার প্যাশন থেকে হয়তো আসেনা। কেবল রুটির তাগিদে কম্প্রোমাইজ করতে হয়। চাকরি গেলে আরেক মিডিয়ায় চাকরি হবে এ নিশ্চয়তাও নেই। 

কিন্তু অন্য অনেক পেশার মত কেবল রুটিরুজির উৎস নয় সাংবাদিকতা পেশা। এখানে প্রতিনিয়ত সরাসরি সত্য, মিথ্যা, অর্ধসত্য ইত্যাদি বিষয়কে ডিল করতে হয়। থাকে ভয়, চাপ, লোভ, ঘুষ, দুর্নীতি, সেন্সর আরো বিচিত্র ফ্যাক্টর। এগুলো ডিল করতে যে টেকনিক্যাল, ইন্টেলেকচুয়াল সিস্টেম লাগে আমাদের সাংবাদিক রিক্রুটমেন্ট পদ্ধতি তাকে সমর্থন করেনা। এখানে অযোগ্য হলেও নিজের বলয়ের লোক নিয়োগ দেয়া হয়। সুপারিশনির্ভর স্বজন, পরিচিত, কম যোগ্যরা অগ্রাধিকার পায় মালিকলক্ষের স্বার্থে লড়াই করার উদ্দেশ্যে।

কারণ, পশ্চিম থেকে আসা ওয়াচডগ মানে সমাজের সত্যের পাহারাদার কুকুর (পশ্চিমে কুকুর আমাদের দেশের মত অপছন্দের প্রাণী নয়), আর আমাদের দেশের ওয়াচডগ মানে মালিকপক্ষের অবৈধ কার্যক্রমকে পাহারা দেয়া ঘেউ ঘেউ করা কুকুর। এই পার্থক্য হয়েছে আমাদের ঘূণেধরা রিক্রুটমেন্ট পদ্ধতির কারণে। এটি সংস্কার করে শুরু করা যেতে পারে তথ্য বিপ্লব। 

তা না হলে কথিত মূলধারার গণমাধ্যম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কাছে চূড়ান্তভাবে পরাজিত হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। তখন, মানুষ কোন তথ্যেই আর বিশ্বাস পাবেনা। অবিশ্বাস, সংশয়, সন্দেহ এর জালে বন্দি হবে সত্য। সংবাদ আর সত্যের মধ্যে আলোকবর্ষ দূরত্ব হবে। সত্য দূরে দীর্ঘশ্বাস ফেলবে আর আমরা মিথ্যার পর মিথ্যা নিয়ে পরস্পরের সঙ্গে তর্ক, বিবাদ, দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়বো!

(পরবর্তী আলোচনায় থাকবে কীভাবে সমাজের মেধা, বুদ্ধিবৃত্তি চর্চাকারীদের হাত থেকে গণমাধ্যমের মালিকানা হাত ছাড়া হয়ে ব্যবসায়ীদের হাতে গেলো। আরো থাকবে, কীভাবে মেরুদণ্ড সোজা রেখে ব্যক্তিত্ব উন্নত রেখেও বিজ্ঞাপন পাওয়া যায়। একটা ক্লু দিই। বিজ্ঞাপন কেন দেয়? আপনার অডিয়েন্স আছে বলেই তো না? তো অডিয়েন্স বিল্ড আপে জোর না দিয়ে, কথিত মালিকদের রক্ষাকুকুর হচ্ছেন কেন? অডিয়েন্স ধরার ব্যর্থতার কারণে?)
পাঠ অনুভূতি

Post a Comment

0 Comments