সর্বশেষ

জমিদার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঢাবি, বাঙ্গালী মুসলমান ও রবীন্দ্র মৌলবাদ | প্রতিবয়ান

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মুসলমান বিষয়ক বাদ-বিবাদ
~®~
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আপনি পড়তে পারেন। তার গান শুনতে পারেন। তার গল্প নিয়ে কথা বলতে পারেন। কিন্তু রবীন্দ্র সাহিত্যকে আদর্শ ধরে এ যুগে কোনো বিপ্লবী চিন্তা বা কাজ আপনি আগাতে পারবেন না। কারণ, সৃষ্টিগতভাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির আধিপত্য মেনে নিয়েই জীবন যাপন করেছেন এবং মাঝেসাঝে যে অভিমানী হয়েছেন—নাইট উপাধী পরিত্যাগ ইত্যাদি করে—তার কোথাও কিন্তু ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলনের প্রতি জোরালো সমর্থন আপনি দেখবেন না। 
এ কারণেই শোষক বা অনিয়ম বা জালিমের বিরুদ্ধে আদি রবীন্দ্রসাহিত্যকে ব্যবহার করা অনেক কঠিন, বরং ব্যবহারকারীকে এক নতুন রবীন্দ্রনাথ বিনির্মাণ করতে হয় রবীন্দ্রনাথকে প্রতিবাদী কর্মে যুক্ত করতে। আমাদের আজকের দিনের রবীন্দ্রপূজারিগণ এটি অনেকাংশে জানেন না, যারা জানেন তারা আবার কেউ কেউ সচেতনভাবে রবীন্দ্র মৌলবাদ ফেরী করেন। 

২।
যে সাহিত্য জালেম বা শোষকের বিরুদ্ধে জনগণকে জাগিয়ে তোলেনা সেই সাহিত্যের প্রতি—এ সাহিত্য রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, সৈয়দ আলী আহসান, আল মাহমুদ যেই লেখুক না কেন— অতিভক্তি করলে একজন মানুষের বা একটি জাতির জালিম বা দুঃশাসন থেকে মুক্তি আসতে পারেনা। ঠাকুর বেঁচে থাকতেই সাহিত্যের প্রতিবাদী চেহারার রূপ হাজির করেছেন অনেকেই। তাদের পিঠ চাপড়ে উৎসাহ তো দিতে পারতেন তিনি! সেটি দেননি। এ নিয়েই সলিমুল্লাহ খান - Salimullah Khan লিখেছেন 'ঠাকুরের মাৎসন্যায়' গ্রন্থে। 

৩)
ঠাকুরের সাহিত্য আপনি পড়তে পারেন, কোনো সমস্যা নাই। চাকরি, বাকরি, প্রেম-পিরিতিতে ঠাকুরকে ব্যবহার করার অফুরান সুযোগ আছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আপনি ঐ সাহিত্য পড়ে জীবনে বিশুদ্ধ বিপ্লবী চেতনা অর্জন বা অর্জনের পর কার্যে পরিণত করতে পারবেন না—পারলেও খুব কম আছে এমন ঘটনা। ব্যতিক্রমকে উদাহরণ হিসেবে আনলে টানতে পারেন সেই নজির। 

কারণ, বাই ন্যাচার রবীন্দ্র সাহিত্য মূলত সমাজের সুবিধাবাদী সাহিত্য। উনি তো কষ্ট জানেন না ভাত না খাওয়ার, যোগ্যতা সত্ত্বেও কেউ বঞ্চিত হওয়ার, কিংবা কেবল ধর্মের কারণে কেউ চাকরি পাচ্ছেনা সেটি বোঝার! ১৭৫৭ সালে ব্রিটিশ দখলদারপাল বাংলাসহ ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের যে খারাপ দশায় ফেললো এবং আরো বিস্তৃত করলে মুসলিম, দলিত হিন্দু ও শিখ-জৈনদের ব্রাহ্নণ্যবাদের কবলে পড়তে হলো, সেই কষ্টকে উনি কি ধারণ করেছিলেন? মনে হয় না। 
৪)
সমসাময়িক ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি না লিখে যাওয়া কিংবা মুসলমান জনগোষ্ঠীর বা দলিত হিন্দুর কথা না লিখতে পারার দায় রবীন্দ্রনাথকে নিতে হবে যদিও 'ঐকতান' কবিতায় উনি উনার অক্ষমতা স্বীকার করে গেছেন। যার খেয়ে, যার পরে তার জীবন কাটলো তাদের জীবন তাকে কেনো ভাবালোনা? শুধু 'আমি ওদের জানিনা, তাই লেখিনা' বলে দায় এড়ানো যাবে? এটি বলেছিলেন বন্দে আলী মিয়ার কাছে। বন্দে আলী মিয়া মুখ ফুঁসকে প্রশ্ন করেই বসেছিলেন যে, ও ঠাকুর মহাশয়, যাদের টাকায় আপনার জমিদারি আপনার সাহিত্যে সেই মুসলমান কই?

জসীমউদ্দিন 'ঠাকুরবাড়ির আঙিনা' তে স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, রবীন্দ্রনাথ হিন্দুত্ববাদী পত্রিকাই পড়তেন, তার ঘরে মুসলিম ন্যারেটিভ প্রচার হওয়া কোনো খবরের কাগজ রাখা হতো না (জসীম এই দায় রবীন্দ্রনাথের আশেপাশে যারা আছেন তাদের দিয়েছেন! আহ কী নিষ্পাপ)৷ শুধু তাই? জসীম জানাচ্ছেন, যোগ্যতা থাকার পরেও জসীম মুসলমান হওয়ায় তার জন্য সুপারিশপত্র লিখতে অস্বীকার করেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। জসীম জানান, রবীন্দ্রনাথ হিন্দুদের প্রতিক্রিয়াশীল অংশের প্রতিক্রিয়ার কথা ভেবে এটি করেননি৷ তো এতো বড় কবি তো সেই ধর্মের শৃঙ্খলা ভাঙতে পারলেন না। তিনি নিজে উগ্র নন, কিন্তু উগ্রদের পরাজিত করার ইনিশিয়েটিভ কি নিয়েছিলেন?
৫)
আহমদ ছফাও একটি সময়  রবীন্দ্রঘোরে ছিলেন, ১৯৯২ এর পর ছফার ঘোর কাটে বলে সলিমুল্লাহ খান জানাচ্ছেন! জনৈক মোর্তজার প্রশ্নে তিনি বুঝতে চেষ্টা করেন, আরে গোরাকে তো দলিত হিন্দু বা মুসলমানদের ঘরে জন্ম দিয়েও বিপ্লব করাতে পারতেন রবিঠাকুর!

ছফার কথা উল্লেখ করে সলিমুল্লাহ লেখেন: এক্ষণে আমরা আহমদ ছফার বিশেষ প্রশ্নটির খবর লইতে প্রস্তুত। ঠাকুরের শ্রীচরণে তিনি নিবেদন করিলেন: আপনি মনে মনে নিজেকে 'হিন্দু' ভেবেছেন। তাতে দোষের কিছু নেই।' (ছফা ১৯৯৪:৬৭  সলিমুল্লাহ ২০২৪,৩০)। 

আমি অবশ্য ছফার মনতত্ত্বে বিশ্বাসী না, কারণ, কারো মনের খবর আমি জানবো কীভাবে? বরং রবীন্দ্রনাথের নানা কর্ম বিবেচনা করেই দেখানো যাবে উনি ঐ সময়ে গোঁড়া হিন্দুত্ববাদীদের এজেন্ডার বাইরে কাউন্টার হিজিমনি তৈরিতে কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক ভূমিকা রাখতে পারেননি৷

দুর্ভাগ্যজনকভাবে উনার প্রেমে মশগুলরাই ১৯৪৬ সালে কলকাতায় মুসলমান নিধনে নেতৃত্ব দেয়। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী পড়লে সেই 'মহাহত্যাযজ্ঞের' নির্মম চিত্র জানতে পারবেন। মুসলমানদের কচু কাটা করা ঐ ঘটনার বর্ণনা বদরুদ্দিন উমরের বাবা আবুল হাশিমের 'আমার জীবন ও বিভাগপূর্ব রাজনীতি' বা আবুল মনসুরের 'আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছরে' পাবেন। তপন রায়চৌধুরী 'বাঙ্গালনামা'তে রবীন্দ্রপ্রেমী কলকাতার বাবুদের মুসলিম নিধনে সে কী আগ্রহ যে দেখেছেন!

৬)
রবীন্দ্রনাথের পুঁজিবাদী স্বরূপ আরেকজন লেখক আহমদ শরীফ দারুনভাবে খুলে দিয়েছেন! আহমদ শরীফের বিচিত্র প্রবন্ধ পড়লে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুঁজিবাদী শ্রেণির আচরণ দেখবেন উনি সুন্দরভাবে বের করেছেন। 

আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতা নিয়ে যে কথা অনেকে বলেন যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 'গড়ের মাঠে বিরোধিতা করেননি' তারা শুধু গভীরভাবে ভাবলেই হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে। 
গড়ের মাঠে বা কোনো সভায় গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিবৃতি দেওয়ার প্রয়োজন নাই রবীন্দ্রনাথের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সম্মত না হওয়ার ব্যাপারে। কেনো? 

কারণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কোনো বিবৃতি আছে? কোনো চিঠি আছে? কোনো নিবন্ধ বা প্রবন্ধ আছে? এই যে মুসলমান অধ্যুষিত পূর্ব বাংলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পক্ষে তৎকালীন সময়ের সেলেব্রিটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কোনো বিবৃতি নাই, লেখাটেখা নাই এটাই তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবস্থান বোঝার জন্য যথেষ্ট। নয় কি?

এখন, তার এই কিছু না বলাকে যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় মৌনসম্মতি হিসেবে পাঠ করেন তারাই আসলে রবীন্দ্রঘোরে আছেন। কারণ, রবীন্দ্রনাথের এই বোবা দশা যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে মৌনঅসম্মতি হিসেবেও পাঠ করা যায়—এবং এই পাঠে সম্মতির চেয়ে অধিক তথ্য, যুক্তিই পাওয়া যাবে—সেটি তারা ভাবছেন না। ঘোরে আছেন তো, নন্দনতাত্ত্বিক ঘোর—এখন অবশ্য নন্দনের পাশাপাশি অনন্দনতাত্ত্বিক ঘোরও থাকার কথা!
আর একটা চমকপ্রদ তথ্য আপনারা তুলনা করলে বুঝবেন, রবীন্দ্রনাথ আদৌ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা চায়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয় ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের ১ জুলাই। ঐ একই বছর ৫ মাস পর অর্থাৎ ১৯২১ সালের ২৩ ডিসেম্বর পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেন। বোঝা যাচ্ছে, রবীন্দ্রনাথের ধ্যান-জ্ঞান ছিলো ঐ বিশ্বভারতী নিয়ে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কখনোই তার আগ্রহের বিষয় ছিলোনা। এ কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নীরবতাই মূলত এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তার মৌনঅসম্মতি ধরে নেওয়া যায়। এটা কেউ না ধরলে বুঝতে হবে সে ঠাকুরের মনস্তত্ত্ব ও ইতিহাসের ধারাবাহিকতা এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য ও শুভাকাঙ্ক্ষা থেকে মুসলমান সমাজ বাদ পড়ার বিষয়ে অজ্ঞতার নিম্নাবস্থায় বাস করছে।
৭।
তো, এখন আসেন কেনো ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে গঠিত নাথান কমিশনের সুপারিশের ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বা সেই সময়ের কলকাতাকেন্দ্রীক বাবুদের গোস্বা থাকে। এর জন্য আপনাকে ১৯০৫ এ যেতে হবে। 

ব্রিটিশ শোষণ নীতি হোক আর অপ্রত্যাশিত সুনীতি হোক যেকোনো কারণে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ তথা পূর্ব বাংলা ও আসামকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা নতুন প্রদেশ এ অঞ্চলের মুসলমান ও দলিত হিন্দুদের জন্য সুবিধা তৈরি করলো। তপনের মতে, 'ব্রিটিশদের অধীন চাকরিনির্ভর' কলকাতার বাবুদের এটি সহ্য হলো না! তারা উপরে ব্রিটিশ ভেতরে আদতে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করলো। 

এতকাল তাদের 'স্বাধীকারের চেতনার বিস্ফোরণ ঘটেনি', কিন্তু তাদের ভাষায় 'মুসলমান চাষী'দের উন্নতির নীতির কারণে গর্জে উঠলো হাতিয়ার। বঙ্গভঙ্গবিরোধী এমনই এক হাতিয়ার ক্ষুদিরাম! বাচ্চা ছেলে, অনেক প্যাঁচ না বুঝে জীবনটা উৎসর্গ করেছেন! 

তো  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই হাতিয়ারদের বুদ্ধিবৃত্তিক নেতা ছিলেন। তিনি কাঙাল হরিনাথের জনপ্রিয় সুর মেরে দিয়ে লিখলেন 'আমার সোনার বাংলা'। দুই বাংলা রক্ষায় প্রচলন করলেন 'রাখী বন্ধন' ও নানা কিছু। এর মধ্যে ১৯০৯ সালে ব্রিটিশ ও পশ্চিমাপন্থীরা ঐদিকে শেষ স্বাধীব তুর্কি সুলতানকে উচ্ছেদ করছে৷ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামাও বাজছে! এতে ভারতের সৈন্যদের বা ভারতের ফসলও জরুরি। 

হামলা-সংঘাতের কারণে এবং আসন্ন সংকটে ভার‍তের কৃষকের সম্পদ হারানোর ভয়ে, সেনা পাওয়া আশায় ব্রিটিশরা ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করে। ঢাকা তার দীর্ঘদিনের রাজধানী মর্যাদা হারিয়ে আবার বঞ্চিত হয়। 
১৯১২ তে নাথান কমিশিন গঠন করা হয় যেটি ১৯১৩ তে আবার সুপারিশ দেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গঠনের। সেটি হতেও ১৯২১-২২ লেগে যায় যখন আবার খেলাফত ও স্বরাজ আন্দোলনের কারণে হিন্দু-মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ। 

সেই বছরেই, মানে ১৯১৩ তে আবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। পরের বছরই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। 
আমি বলতে চাচ্ছি, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, বঙ্গভঙ্গ, নাথান কমিশন এবং রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়া কিছুতেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। আর এ কারণেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কিছুই বলেননি। কারণ, ক) বঙ্গভঙ্গ রদ হয়েছে৷ জমিদারি রক্ষা পাইছে এবং খ) বোনাস হিসেবে নোবেল পুরস্কার আসছে। এই আলোচনাটা আমার আগে দুনিয়ায় আর কেউ এনেছে বলে মনে হয় না। 

এ প্রসঙ্গে আরেকটি আলাপ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্ববিদ্যালয় বানিয়েছেন কই? শান্তিনিকেতন। কিন্তু তার জমিদারি আবার পূর্ববঙ্গের কুষ্টিয়া, সিরাজগঞ্জ ইত্যাদি জায়গায়! বিশ্বভারতী গিয়ে শান্তিনিকেতনে হওয়া এটা প্রমাণ করতে যথেষ্ট যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না। 

৮)
আপনার সমাজের বৈষম্যকে হারাতে হলে পুঁজিবাদীদের পছন্দের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে হারাতে হবে। এটা রবীন্দ্রনাথ বিদ্বেষ নয়, রবীন্দ্রনাথ গরীবের না ধনির এই প্রশ্নের উত্তর অনেক গরীব লোকও রবীন্দ্র সঙ্গীত শোনে—যেমন আমি—তথাপি ইনস্টিটিউশন হিসেবে রবীন্দ্রনাথ বাই নেচার 'এলিট'! 

এলিট মানে গণবিচ্ছিন্ন অর্থাৎ—গণসমস্যা, গণবয়ান, গণের অধিকার, গণআন্দোলন, গণবিপ্লব—ইত্যাদির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের মিল হবে না। সাময়িক হলেও দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক সম্ভব নয়। বরং রাবীন্দ্রিক আবহাওয়া ধীরে ধীরে একজন মানুষের কণ্ঠস্বর নীরব করে দেয় কী না, জালিমের সঙ্গে বোঝাপড়ায় দীর্ঘমেয়াদে রবীন্দ্রনাথ নরম করে দেয় কী না এই নিয়ে তর্ক হতে পারে। কারণ, ১৯৪৭ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বোঝাপড়াটা আমাদের পাকিস্তানী ভাবাদর্শের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক লড়াইয়ে রসদ জুগিয়েছে। কিন্তু আমি সামগ্রিক বিবেচনায় বলছি যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন এলিটের মালিকানায় যাবেন তিনি আদি ও আসল রবীন্দ্রনাথ হবেন আর আমরা গরীবরা আবার তার মালিকানা নিয়ে তাকে সর্বহারায় রূপান্তর করতে চেষ্টা করি। এই রবীন্দ্রনাথ আমাদের বিনির্মিত রবীন্দ্রনাথ—এই রবীন্দ্রনাথ তো রবীন্দ্রনাথের বা রবীন্দ্র মৌলবাদের রবীন্দ্রনাথ না।

কারণ, আদি ও অকৃত্রিম এই রবীন্দ্রনাথ আপনাকে আত্মকেন্দ্রীক করবে, যে রবীন্দ্রনাথ আপনাকে গরীব-দুঃখীর জন্য ত্যাগী করবে সেই রবীন্দ্রনাথ যদি থাকেও, তা চর্চা কে করবে? 

৯)
অনেকেই তো আজফার হোসেনের মতে, 'নন্দনতাত্ত্বিক ঘোরে' আছে৷ গতকাল দেখলাম, জাবির ছাত্র ইউনিয়নের এক বাঘা বড় ভাই মার্ক্সের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের তুলনা করে লিখছেন৷ অথচ দুইজন দুই দিগন্তের লোক। রবীন্দ্রনাথ পশ্চিমা শ্রেষ্ঠত্ববাদে বিশ্বাসী পুঁজিবাদী, ভোগবাদী লোক এবং কার্ল মার্ক্স হচ্ছেন সর্বহারার লোক। এ দুইজন এক হতে পারেননা। মার্ক্সের সঙ্গে উপমহাদেশের কোনো কবির তুলনা হলে সেটি হবে বিপ্লবী নজরুল। 

অবশ্য আজফার হোসেন বলেন, যে বিউপনিবেশায়ন ব্যবসায় একাডেমিয়ায় আছে সেখানে উপরে থাকা ফানোঁদের বহু আগেই নজরুল উপনিবেশবিরোধী লড়াই একাই জারি করেন৷ আজফারের সঙ্গে আমি এই বক্তব্যেও একমত যে, নজরুলই সবার আগে দৃপ্তকণ্ঠে ভারতের স্বাধীনতার ডাক দেন। 

তার সাম্যবাদী কাব্য পৃথিবীর সমস্ত যুগের বিপ্লবীদের হাতিয়ার। অন্যদিকে, রবীন্দ্রনাথ উত্তর ভারতের গোঁড়া হিন্দুত্ববাদীদের নায়ক শিবাজিকে নিয়ে কবিতা লিখতে পারলেন, তিনি পারলেন এক ব্রিটিশ রাজার বন্দনা করতে তবে কোনো মুসলিম বিপ্লবী তার চোখে পড়েনি৷ 'ক্বতলই দিল্লি' নিয়ে তার লেখা নাই, তবে সিরাজের চরিত্রহানী করে লেখা মিথ্যাচারকে তিনি ফেরী করতে ভুল করেননি৷ এসব খন্ডণ করে অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় 'সিরাজ-উদ-দৌলা' লিখলে তার স্মরণ হয়, সিরাজের ওপর জুলুম করা হয়েছে।

আহমদ শরীফের মতে, বণিক ও ধনিক শ্রেণির প্রতিনিধি হিসেবে রবীন্দ্রনাথ তার মুসলিম প্রজাদের সঙ্গে নিঃসন্দেহে ইনসাফ করতে পারেননি।

১০)
এর বাইরে, বাংলাদেশের মুসলমানদের ইতিহাসে মুসলমানদের জন্য রবীন্দ্রনাথের ইনসেনটিভ প্যাকেজ কই—সাহিত্য বা জমিদারি যেদিক থেকেই বলেন। 
সলিমুল্লাহ খান - Salimullah Khan সম্পাদিত আহমদ ছফার 'গরিবের রবীন্দ্রনাথ' এ ধরনের কিছু প্রশ্ন হাজির করেছে।

রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তি হিসেবে ক্ষমা পাবেন। কারণ, তিনি গা বাঁচিয়ে সমালোচনার বাইরে থাকতে চেয়েছেন। তিনি দাঙ্গার বিরুদ্ধে কোনো স্পষ্ট অবস্থান নেননি, আবার নানা সংঘাতে উস্কানিও দেননি। এ কারণে, ক্ষমা তিনি পেতে পারেন। তিনি নোবেল পেয়েছেন। বিশ্বসাহিত্যে বাংলাকে নিয়েছেন। 

কখন পেয়েছেন সেই প্রশ্ন যদিও তোলা যায়। আমি তুলি। উপরে তুলেছি। যখন ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষের সমর্থন দরকার পশ্চিমাদের সেই সময়ে পাওয়া এই নোবেল পুরস্কারের রাজনৈতিক অর্থনীতি গভীর। আজকের যুগে দেখেননা কারা নোবেল পায়? নোবেল পুরস্কার বিশেষ করে সাহিত্য ও শান্তির পুরস্কার নিঃসন্দেহে পশ্চিমাদের স্বার্থের অনুকূলে রাজনৈতিক কারণেও দেওয়া হয়। ভুলে গেলে চলবে সেই 'অন্য বা অপর' আলাপ? 

তো রবীন্দ্রনাথকে ক্ষমা করেন। কিন্তু রবীন্দ্র মৌলবাদকে ক্রিটিক করতে হবে। এই ক্রিটিক হাজির না করতে পারলে বাঙ্গালী হিন্দু-মুসলমানদের সাংস্কৃতিক মুক্তি নাই। বাঙ্গালী মুসলমানদের সাংস্কৃতিক বিকাশের পথে—হিন্দু ও মুসলিম উভয়ের জন্য—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অন্ধ অনুসারী রবীন্দ্র মৌলবাদ প্রতিবন্ধকতা।

রবীন্দ্রনাথকে অতিক্রম করতে হবে, ভাঙতে হবে এবং রবীন্দ্রনাথকে সমালোচনার ঊর্ধ্বে ভাবা যাবেনা। ভাঙাগড়ার মাধ্যমে গণমানসে যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর টিকে থাকবেন সেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। আর এই কারণেই রবীন্দ্র সাহিত্যকে আসমানী কিতাব ভেবে রবীন্দ্রনাথকে সমালোচনার ঊর্ধ্বে রাখার রবীন্দ্র মৌলবাদী চিন্তাকে পরাজিত করতে হবে—যুক্তি, তর্ক, উপাত্ত ও ইতিহাসের নির্মোহ উপস্থাপনের মাধ্যমে। 

তবেই মুক্তি। রবীন্দ্র মৌলবাদকে প্রশ্ন করুন। প্রশ্নেই মুক্তি কারণ— আমি বিশ্বাস করি—প্রশ্নই উত্তর।
পাঠ অনুভূতি

Post a Comment

2 Comments

  1. অসাধারণ বিশ্লেষণ! মহান আল্লাহ আপনার জ্ঞান বৃদ্ধি করুন।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ। দয়া করে শেয়ার করুন।

      Delete